উৎপাদনে থাকা রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের উন্নয়নে শেভরনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়। আমেরিকান কোম্পানিটি ইজারা নেওয়ার প্রস্তাব জমা দিয়েছিল।
গত বছরের মাঝামাঝি বিষয়টি আলোচনা এলেও ডিসেম্বর নাগাদ লিখিত আবেদন দেয় শেভরন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরিক এম ওয়াকার। কোম্পানিটি বিশেষ বিধান আইনের আওতায় কাজটি দেওয়ার অনুরোধ করে। প্রস্তাবে বলা হয়, রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের একটি স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি। অন্যান্য স্তরে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। শেভরন দুটি কূপ খনন করে নিচের স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলন নিশ্চিত করতে চায়, এ কাজটি করতে ২ থেকে আড়াই বছর সময় প্রয়োজন।শেভরনকে দেওয়া হলে তারা উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারবে।
রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের মালিকানা স্বত্ব রয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিএফসিএল) হাতে। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমার এ বিষয়ে খুব বেশি জানা নেই। শেভরন যদি চিঠি দিয়ে থাকে সেটি হয়তো মন্ত্রণালয় অথবা পেট্রোবাংলায় দিয়ে থাকতে পারে। তবে একটি সভায় আমি উপস্থিত হয়েছিলাম, সেখানে শেভরনের উন্নয়ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। সেই প্রস্তাবে তারা গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রস্তাব তুলে ধরে। আমি তখন বলেছি, আমরা নিজেরাই গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন দুটি কূপ (১১ ও ১২) খনন ও ৩টি কূপের ওয়ার্কওভারের কাজ হাতে নিয়েছি। শিগগিরই উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
পেট্রোবাংলা সুত্র জানিয়েছে, ১৯৬০ সালে আবিস্কৃত হয় রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড। এখানে প্রমাণিত মজুদ ১০৬০ বিলিয়ন ঘনফুট, সম্ভাব্য রয়েছে ১৩৭৩ বিসিএফ, আরও সম্ভাবনাময় বিবেচনা করা হয় ৬৮০ বিসিএফ। উত্তোলন যোগ্য প্রমাণিত (১পি) ও সম্ভাব্য মিলে মজুদ ধারণা করা হয় ২৪৩৩ বিসিএফ। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত গ্যাস ক্ষেত্রটি থেকে ৬৭৫ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। অবশিষ্ট মজুদের পরিমাণ রয়েছে ১৭৫৭ বিএসএফ।
অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের মালিকানাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ গ্যাস ফিল্ড বিবিয়ানায় প্রমাণিত মজুদ ধরা হয় ৪৪১৫ বিসিএফ, সম্ভাব্য বিবেচনা করা হয় আরও ১৩৪০ বিসিএফ। গ্যাস ফিল্ডটিতে ২০২২ সাল ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৯৯১ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। অবশিষ্ট মজুদ রয়েছে মাত্র ৭৬৩ বিসিএফ।
মজুদ বিবেচনায় বিবিয়ানার তুলনায় দ্বিগুণের বেশি গ্যাস থাকলে উত্তোলনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড। বিবিয়ানা ২৩ আগস্ট ২৬টি কূপ দিয়ে ১০৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করেছে। একই দিনে রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড ৫টি কুপ দিয়ে মাত্র ৪৬.৪ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করেছে। রশিদপুরে এ যাবত ১১টি কূপ খনন করা হয়েছে এর মধ্য ৯টিতে গ্যাস পাওয়া গেছে। ৯টি কূপ থাকলেও ৩টি বন্ধ ও একটি গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত থাকলেও পাইপলাইনের অভাবে বসে রয়েছে ২০১৭ সাল থেকে।
পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক প্রাথমিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, শেভরন বাংলাদেশকে বিবিয়ানাসহ বিশাল এলাকা এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা পরে এসে অনেক জায়গা ছেড়ে দেয়। আমি যখন পেট্রোবাংলায় কর্মরত ছিলাম শেভরন তখন রশিদপুরের বিষয়ে একটি প্রস্তাব দেয়, আমরা তখন বলেছিলাম, এভাবে দেওয়ার সুযোগ নেই, আমরা দরপত্র আহ্বান করি, অন্যরাও অংশ নিক, প্রতিযোগিতায় যার প্রস্তাব আকর্ষণীয় হবে তাকে দেওয়া হবে।
মকবুল ই-এলাহী মনে করেন, এভাবে গ্যাস ফিল্ডটি নিয়ে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। দেশীয় কোম্পানি দিয়ে তুলতে পারলে সবচেয়ে ভালো, না হলে ছেড়ে দেওয়া উচিত। অন্তত আমদানির চেয়েতো অনেক সাশ্রয়ী হবে। এখন আমদানি করতে যে গ্যাসের জন্য ১৩ ডলার দিতে হচ্ছে, সেই গ্যাস এখানে সাড়ে ৪ ডলারের পাওয়া যাবে। এক সময় আমরা বিদেশ থেকে ৪০ থেকে ৫০ ডলারে গ্যাস আমদানি করেছি।
শেভরন বাংলাদেশ ৩টি গ্যাস ফিল্ড পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এর মধ্য সবচেয়ে বড় ফিল্ড বিবিয়ানা।শেভরন এক সময় পুরো গ্যাস ফিল্ড ছেড়ে চলে যেতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। এমনকি চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের আলোচনা অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিল। পরে বাংলাদেশ সরকার নিজে কিনতে চাইলে বিষয়টি ভেস্তে যায়। পরে বিনিয়োগ পরিকল্পনা সম্প্রসারণ করে বিবিয়ানার পার্শ্ববর্তী এলাকা অনুসন্ধানের জন্য গত সেপ্টেম্বর মাসে নতুন চুক্তি করে।
বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা কারণে জ্বালানির দাম এসে তলানিতে ঠেকেছিল। যে কারণে সারা বিশ্বেই জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে কিছুটা স্থবিরতা নেমে এসেছিলে। কিন্তু করোনা পরবর্তী অর্থনীতির গতি সঞ্চার, একইসঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গ্যাসের দাম আকাশচুম্বি হলে নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। শেভরনের পাশাপাশি আরেক মার্কিন কোম্পানি এক্সোন মবিল গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ পেতে দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছে।