আজ রোববার দুপুর ২টা ৩০ মিনেটে সেপ্টেম্বর মাসের দর ঘোষণার মধ্যদিয়ে ৩০তম মাসে গড়াচ্ছে বিইআরসি কর্তৃক এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা কার্যক্রম। কিন্তু নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস পাওয়া নিয়ে অভিযোগ রয়েই গেছে ভোক্তাদের।
প্রথম দিকে বলা হতো, বিষয়টি পুরোপুরি নতুন, মানিয়ে নিতে একটু সময়তো লাগবেই। সময়ের সঙ্গে নির্ধারিত দরে প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়ে যাবে। এখন অন্তত ভোক্তারা বলতে পারছেন, নির্ধারিত দাম এতো আপনি বেশি নিচ্ছেন কেনো। ভোক্তাদের প্রশ্ন আড়াই বছর তো গেল, আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে নির্ধারিত দরে এলপি গ্যাস পেতে।
গত আগস্টে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ঘোষণা করা হয় ১ হাজার ১৪০ টাকা। খোদ রাজধানীর ভাটারা এলাকার এইচ উদ্দিন বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, ৩১ আগস্ট ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। অর্থাৎ সিলিন্ডার প্রতি ২৪০ টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে ওই ভোক্তার কাছ থেকে। অন্যদিকে রাজশাহীর একজন ভোক্তা জানিয়েছে, তিনি আসাম কলোনির জহিরুল ইসলামের দোকান থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা দিয়ে কিনেছেন। মজার বিষয় হচ্ছে এসব দোকানি কোন রকম রশিদ দিতে নারাজ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে নিলে নেবেন না নিলে নাই। আর বিইআরসি কিংবা ভোক্তা অধিদফতরের রশিদ ছাড়া কিছু করার সুযোগ খবুই কম।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক রিটের প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা করে বিইআরসি। তখন এলপিজি আমদানিকারক, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার জন্য ১২ কেজির সিলিন্ডারে মোট ৩৫৯ দশমিক ৪০ টাকা কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল। দর ঘোষণার দিনেই কমিশন নিয়ে আপত্তি তোলেন লোয়াব (এলপিজি আমদানিকারকদের সংগঠন)। এরপর থেকে বিইআরসির সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয় লোয়াবের। তারা প্রতি মাসের দর ঘোষণা বর্জন করে বিভিন্নভাবে বিইআরসির ওপর চাপ তৈরি করে। এমনকি এলপিজি আমদানি বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেন লোয়াবের সভাপতি আজম জে চৌধুরী। বিইআরসি অনেকটা বাধ্য হয়ে ৭ মাসের মাথায় ১০ অক্টোবর ৩৫৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৪১ টাকা করেন। অর্থাৎ ১২ কেজি সিলিন্ডারে এবার কমিশন বাড়ানো হয়েছে ৮১ দশমিক ৬ টাকা। ডিলার এবং খুচরা বিক্রেতার কমিশন বাড়িয়ে যথাক্রমে ৩৪ ও ৩৮ টাকা করা হয়েছে। যেহেতু পণ্যটি প্রায় ৯৮ শতাংশ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। সে কারণে সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে প্রতি মাসের ভিত্তি মূল্য ধরা হয়েছে। সৌদির দর উঠা-নামা করলে এলপিজির মূল্য উঠা-নামা করবে। আমদানিকারকের অন্যান্য কমিশন ও খরচ অপরিবর্তিত থাকবে। কমিশনের সেই নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি মাসে দর ঘোষণা করে এসেছে।
যেভাবে প্রতিশ্রুতি থেকে সরেছে লোয়াব
প্রথম দর ঘোষণার সময় আন্তর্জাতিক বাজার দর যখন নিম্নগামী তখন মাইনাস ওয়ান (আগের মাসের) ফর্মুলায় তাদের কোন আপত্তি ছিল না। আমদানিকৃত গ্যাস সিস্টেমে আসতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লেগে যায় সে কারণে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতেই মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ আগের মাসের দর অনুযায়ী পরের মাসে গ্যাসের দর নির্ধারিত হতে থাকল। কয়েক মাস পরে যখন বাজারে ঊর্ধ্বগতি শুরু হলো, তখনেই বাগড়া দিয়ে বসে এলপিজি আমদানিকারকদের সংগঠন লোয়াব। তারা বলা শুরু করে, মাইনাস ওয়ার্ন ফর্মুলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, বর্তমান মাসের দর অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। বিইআরসি দর ঘোষণার আগেই দাম বাড়িয়ে দেয়। বিইআরসিও তাদের কথায় বাধ্য হয়ে মাইনাস ওয়ান বাতিল করে দেয়। এখন প্রতি মাসের ১ তারিখে আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তি ধরে ৪ তারিখের মধ্যে দর ঘোষণা দিয়ে আসছে বিইআরসি।
লোয়াব দাবি করে আসছে তাদের বিদেশ থেকে আনতে জাহাজ ভাড়া যথাযথভাবে আমলে নেওয়া হয়নি। জবাবে বিইআরসি তাদের কমার্শিয়াল এনভয়েস দাখিল করতে বললেও দাখিল থেকে অনেকেই বিরত থেকেছে। যারা ছোট ছোট জাহাজে এলপিজি আনছে তাদের কয়েকটি এনভয়েস দাখিল করে। লোয়াব বরাবরই দাবি করে আসছে টনপ্রতি তাদের পরিবহন খরচ পড়ছে ১১০ ডলার থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত। লোয়াব যখন এই দাবি করেছে সেই সময়ে মোংলাবন্দর থেকে টিকে গ্রুপের একটি এনভয়েসে সংগ্রহ করে তাতে টন প্রতি মাত্র ৬৫ ডলার জাহাজ ভাড়া দেখা গেছে। বিষয়টি বিইআরসি জানলেও চাপের মুখেই পরিবহন খরচ ৯৫ ডলার করে দেয়। যদিও তাদের এপ্রিলের আদেশে বলা হয়েছিল জাহাজ ভাড়া কমিয়ে আনতে হবে। দরকার হলে কয়েকজন মিলে গ্রুপ করে বড় জাহাজে আমদানি করে পশ্চিমবঙ্গের মতো জাহাজ ভাড়া কমাতে হবে।
ক্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, ২৮টি কোম্পানির মধ্যে গণশুনানিতে মাত্র ১২টি কোম্পানি এনভয়েস দাখিল করেছে। সেই দরের গড় করে দর চূড়ান্ত করার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। আমরা গণশুনানিতে দেখিয়ে দিয়েছি, পশ্চিমবঙ্গে ২০ ডলারে আমদানি করছে, একই দূরত্বে বাংলাদেশে ১২০ ডলার হতে পারে না। আমরা বলেছিলাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কমার্শিয়াল এনভয়েস সংগ্রহ করে যাচাই করতে। বিইআরসি তা না করে ৯৫ ডলার দর চূড়ান্ত করে অন্যায় করেছে।
যথারীতি প্রতি মাসেই এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা করে আসছে বিইআরসি। আর প্রতি মাসেই সাংবাদিকদের প্রায় একই প্রশ্ন থাকে, বিইআরসি নির্ধারিত দরে গ্যাস মিলছে না। বিইআরসির বক্তব্যও প্রায় একই ধরণের থাকে। দর পুরোপুরি কার্যকর হয়েছে এ দাবি করবো না। অনেক জায়গায় নির্ধারিত দরেই বিক্রি হচ্ছে।
গত মাসে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেছেন, আমরা নিজেরা অভিযানে যাচ্ছি। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদফতর ও জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে দর মনিটরিং করতে বলা হচ্ছে। ভোক্তাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রথম দিকে বিইআরসি শুধু খুচরা বিক্রেতার ওপর খড়গহস্ত ছিলেন। বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল আমিন কমিশনে যোগদানের পর এবারেই প্রথম এলপিজি কোম্পানির ওপর নজর দিয়েছে। বেশি দামে বিক্রি করায় ইতিমধ্যেই ইউনাইটেড এলপিজি লিমিটেড ও টোটাল গ্যাসকে শোকজ করেছে। তাদের লাইসেন্স বাতিলের পথে হাঁটছে বিইআরসি।