প্রথম দুই কমিটির তদন্তে দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রমাণিত সেই এম এ মাজেদের দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি তৃতীয় কমিটি। প্রথম দুই তদন্ত রিপোর্টকে একপেশে বলতে চাইছেন পাটোয়ারী কমিটি।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মাজেদের দুর্নীতি প্রথম সমানে আসে আলী মো. আল মামুন কমিটির (পেট্রোবাংলা) রিপোর্টে। অধিকতর তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ (পেট্রোবাংলা) কমিটি তথ্য উপাত্তসহ সত্যতা নিশ্চিত করেন। দুই তদন্তের প্রেক্ষিতে ওএসডি করা হয় এম এ মাজেদকে।
সর্বশেষ আব্দুল মান্নান পাটোয়ারী কমিটি (পেট্রোবাংলা) নির্দোষ বলে সাফাই গেয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে এম এ মাজেদকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। পাটোয়ারী কমিটি বলতে চাইছেন, আগের তদন্তগুলো একপেশে করা হয়েছে। অভিযুক্তের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আব্দুল মান্নান পাটোয়ারী বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, একটি তদন্ত রিপোর্টকে অধিকতর যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। আমরা সেই রিপোর্ট জমা দিয়েছি। রিপোর্টে কি আছে সে বিষয়ে কোন তথ্য দেওয়া সম্ভব না। তবে ওই রিপোর্টের কিছু অংশ একপেশে ছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন পেট্রোবাংলার তৎকালীন পরিচালক আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ। তার রিপোর্টকে একপেশে বলা হয়েছে তৃতীয় তদন্তে। এ বিষয়ে আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, ভার্চুয়াল মিটিংয়ে সিনিয়র সচিবকে মিথ্যুক প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। এর চেয়ে আর কি প্রমাণ দরকার হয়। বোর্ডের অনুমতি ছাড়া পুনঃসংযোগ দিতে পারে না, দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরপর আর কি প্রমাণ দরকার হয়।
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে থাকা কেজিডিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ পাওয়ার পর ঘুষ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েন এম এ মাজেদ। আইনকানুনের কোন বালাই ছিল না তার কাছে। কেউ কেউ কর্ণফুলীতে ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলেছেন তবুও সংযোগ পাননি। আবার ঘুষ ঢালায় একদিনেই সংযোগ পাওয়ার নজির তৈরি করেছেন।
দ্বিতীয় তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশ, মেসার্স মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত শিল্প-৫১৫১) আবেদন করেছেন ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। পরদিনেই (২০ ডিসেম্বর) তাকে সংযোগ প্রদান করা হয়। সব ধরনের আইন অমান্য করে মাত্র সেই সংযোগটিও প্রদান করা হয়েছে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ক্যাপটিভ পাওয়ারে। মেসার্স মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড ৯০০ কিলোওয়াট ক্ষমতার ক্যাপটিভের আবেদনটি বোর্ডে তোলার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু সেই বিধি নিষেধ না মেনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মাজেদ মোটা অংকের বিনিময়ে নিজেই অনুমোদন দিয়েছেন।
পেট্রোবাংলা গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বোর্ড সভার অনুমোদন না নিয়ে নিজেই অনুমোদন করেছেন। একই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও একটি জালিয়াতির তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাতে দেখা গেছে কোম্পানিটি মিটার টেম্পারিং করে বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরির ঘটনা ঘটলেও ধামাচাপা দিয়েছেন এম এ মাজেদ সিন্ডিকেট। কোম্পানিটিতে পরীক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভাগ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মার্কেটিং বিভাগকে দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ মিটার পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠনও রহস্যজনক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার আস্থাভাজনদের রেখেছেন ওই কমিটিতে। যাতে সুবিধামতো রিপোর্ট দিয়ে টুপাইস হাতানো যায়।
৫ কোটি ৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বকেয়ার কারণে মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্সের একটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। নিয়ম রয়েছে ৫০ শতাংশ বকেয়া পরিশোধ এবং অবশিষ্ট টাকা কিস্তিতে আদায়ের শর্তে পুনঃসংযোগ দিতে পারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কিন্তু কোন টাকা আদায় না করেই পুনঃসংযোগ প্রদান করেন।
মেসার্স ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত ৮০৬৫) নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সংযোগ প্রদানে অভিনব জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সংযোগের জন্য আবেদন জমা দিলে ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর বোর্ডে তুলেছিলেন তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সেই বোর্ড সংযোগটি অনুমোদন করেননি। এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় জানার পরও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ডায়মন্ড সিমেন্টকে সংযোগ প্রদান করেছেন এম এ মাজেদ। এতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পরিপত্র অমান্য করা হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি উল্লেখ করেছে।
বোর্ডের সিদ্ধান্ত জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। দেখা গেছে বোর্ডে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে এক রকম, আর কার্যপত্রে লেখা হয়েছে ভিন্নভাবে। ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ১৭৫তম বোর্ড সভায় ওঠে মেসার্স সায়মা সামিরা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড (সাদ মুছা গ্রুপ) নতুন সংযোগের আবেদন। পর্ষদের সভার পূর্বেই ওই গ্রাহকের অনুকূলে চাহিদাপত্র ইস্যু করার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কেজিডিসিএল’র দুর্নীতির বিষয়ে দ্বিতীয় কমিটি গঠন (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২) করা হয় পরিচালক (পরিকল্পনা) আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ এর নেতৃত্বে। ৪ সদস্যের ওই কমিটি গঠনই করা হয় পরিচালকের (অপারেশন এন্ড মাইন্স) নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে। আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আগের কমিটির রিপোর্টের অধিকতর তদন্ত করতে।
আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ কমিটি তদন্তে অসংখ্য অনিয়মের পাশাপাশি কেজিডিসিএল’এ একটি সিন্ডিকেটের প্রমাণ পেয়েছেন। কমিটি তার ৩১ পৃষ্ঠার রিপোর্টে অসংখ্য দুর্নীতির তথ্য তুলে এনেছেন।
এতো এতো তথ্য প্রমাণ যার বিরুদ্ধে, সেই এম এ মাজেদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পেট্রোবাংলা কখনই আন্তরিক ছিল না। সময়ক্ষেপণ করার কৌশল নেওয়া হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক চিঠির পর তাকে ওএসডি করা হয়। এখন আবার অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়া চলমান বলে জানা গেছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল খালেক মল্লিক বার্তা২৪কম-কে বলেছেন, এ বিষয় আমার ভালো জানা নেই। পেট্রোবাংলার একটি কমিটি কাজ করছে তারা ভালো বলতে পারবে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত এম এ মাজেদ বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, তদন্তাধীন বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে পারবো না। আগের দুই রিপোর্টে আপনার দুর্নীতিবাজ বলা হয়েছে, এ বিষয়ে আপনার কোন বক্তব্য আছে কি? এবারও তিনি কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
একাধিকবার ফোন দিলেও পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান রিসিভ করেননি। এমনকি এসএমএস দিলেও সাড়া দেননি।