অবৈধ গ্যাস সংযোগ ঠেকাতে আরও কঠোর হচ্ছে সরকার, জরিমানার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা সংযোজন করে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে পেট্রোবাংলাকে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে পেট্রোবাংলা কাজ করছে। প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, খুব শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে। কি ধরণের শাস্তির বিধান থাকছে এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেন, আমরা চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করার পর এ বিষয়ে অবগত করবো। এখনই এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।
তিনি বলেন, আমরা গ্যাসের সামগ্রিক সিস্টেম লস কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছি। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে চুরি, সেই চুরি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর আবার তারা সংযোগ নিচ্ছে কিনা একমাস পর আবার ফলোআপ করতে বলা হয়েছে। বিতরণ কোম্পানির কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আমরা জোনগুলোকে ভাগ করে দিয়েছি এখন জানতে পারছি কোন জোনে কতটুকু গ্যাস যাচ্ছে, বিল কত পাচ্ছি। ডিএমডিদের বলে দেওয়া হয়েছে তাদের জোনের সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে হবে। সিস্টেম লস কমাতে না পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্স মিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (ভিজিল্যান্স) তৌহিদুল ইসলাম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, এ বিষয়ে কঠোর আইন করা সময়ের দাবি। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর আবার সেই সংযোগ চালু হচ্ছে। একই এলাকায় একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে। এভাবে চললে গ্যাস চুরি পুরোপুরি বন্ধ করা কঠিন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা শুধু সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারি। আমাদের আর কিছুই করার নেই। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ যাচ্ছি তিনি জরিমানা কিংবা শাস্তি দিচ্ছেন। কখনো জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ডও দিয়ে থাকেন।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (মেট্রো ঢাকা বিপণন ডিভিশন-উত্তর) মো. ইমাম উদ্দিন শেখ বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, কেউ যদি চুরি করে, প্রচলিত আইন রয়েছে বিচার বিভাগ রয়েছে, অনেক সংস্থা রয়েছে। পেট্রোবাংলা কিংবা তিতাসের শাস্তি দেওয়ার কোন ক্ষমতা নেই। অপরাধী যদি আমার গ্রাহক হন, তাহলে তার জরিমানা করতে পারি। ক্ষেত্র বিশেষে জরিমানার পরিমাণ ভিন্ন রয়েছে। আবাসিকে কেউ অবৈধ ব্যবহার করলে তার জন্য এক বছরের সমপরিমাণ বিল আদায় করতে পারি। তবে ব্যবহারকারী যদি তিতাসের গ্রাহক না হন, তাহলে আমরা শুধু লাইন কেটে দিতে পারি। কিছু ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়। অবৈধ ব্যবহারকারী শাস্তি কিংবা জরিমানা করতে হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লাগবে।
সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং বেশি চুরিও তিতাসেই। গ্যাসের ৬টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে তিতাস একাই অর্ধেকের বেশি ৫৫.২৩ শতাংশ গ্যাস বিতরণ করে আসছে। সারা বছর অভিযান চালিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না গ্যাস চুরি। গত ২১ মাস (অক্টোবর-২০২১ থেকে জুন-২০২৩) অবৈধ উচ্ছেদ অভিযানে ৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা খরচ করেছে তিতাস গ্যাস।
কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত ৩৩০ টি মোবাইল কোটসহ ২৮ হাজার ৩৯৮টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এসব অভিযানে ৬৬৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার অবৈধ লাইন, অবৈধ সংযোগ ও বকেয়ার কারনে ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮৪টি চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ মোট ৬ লাখ ৩ হাজার ৯৭৫টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অবৈধ ব্যবহারের কারণে ২৫০টি শিল্প, ৩২৯টি বাণিজ্যিক ৫৫ ক্যাপটিভ ১০টি সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এসব অভিযানের মাধ্যমে ৩২১ কোটি ৮১ লাখ টাকা অতিরিক্ত বিল এবং ৯১ কোটি ২৫ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য্য করা হয়েছে। এরমধ্যে অতিরিক্ত বিল বাবদ ১৪৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ৩৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা আদায় হয়েছে।
তিনি আরও বলেছেন, অভিযোগের কারণে তিতাসের লোকজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমার সময়ে ৮ জনকে বরখাস্ত করেছি, ১৬ জনকে সাময়িক বরখাস্তসহ ২২৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ৯১ জনকে শাস্তিমূলক বদলি করেছি। ৫০ থেকে ৬০ জন ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিচ্ছিন্নের পর পুনঃরায় সংযোগ প্রসঙ্গে বলেন, কিছু সংযোগ হয়তো লাগতে পারে। তবে নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।
সম্প্রতি রাজধানীর কামরাঙ্গীচর এলাকায় অবৈধ সংযোগ ঠেকাতে পুরো এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে চরম বিতর্ক ওঠে বৈধ গ্রাহকদের লাইন বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে। অনেক সময় দেখা যায়, সকালে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, বিকেলে আবার বসিয়ে নিচ্ছে। এভাবে এক ধরণের চোর-পুলিশ খেলা চলছে তিতাস ও অবৈধ ব্যবহারকারীদের মধ্যে।
তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, অবৈধ সংযোগের বিষয়ে আমরা অনেক অভিযান পরিচালনা করেছি। অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমরা জনসংযোগ করছি, বলেছি চুরি ঠেকাতে আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, লোকজনও সচেতন হচ্ছে। গ্রাহকদের বলেছি লাইন কেটে দেওয়ার পর আবার লাইন বসলে সেই অঞ্চলের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হবে। এতে আমরা অনেক ভালো ফল পেয়েছি। তবে আরও কঠোর আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।