বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে বাঁশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ১৭ সেপ্টেম্বর রাত ১২ টায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে বলে বার্তা২৪.কমকে নিশ্চিত করেছেন এসএস পাওয়ার ওয়ান লিমিটেডের সিএফও এবাদত হোসেন ভুঁইয়া।
উৎপাদন শুরুর পর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুই ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১৩২০ মেগাওয়াট। প্রথম ধাপে একটি ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে। যথারীতি আগামী ১ মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে বলে জানিয়েছেন এবাদত হোসেন ভুঁইয়া।
বিদ্যুৎ খাতসহ অনেক দিক থেকেই দিনটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বেসরকারি একক বিনিয়োগ হিসেবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড, আবার বেসরকারি প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগেও রেকর্ড করেছে এর মধ্যদিয়ে। বেসরকারি খাতে বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নেও রেকর্ড স্পর্শ করেছে সাশ্রয়ী খ্যাত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। ১.৭৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থায়ন এসেছে প্রকল্পটিতে। অন্যদিকে এস আলম গ্রুপ নিজস্ব উৎস থেকে অর্থায়ন করেছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শুধু সরকারি মালিকানায় বড় আকারের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। একটি হচ্ছে বাংলাদেশ-চীন সরকারের যৌথ বিনিয়োগে পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। অপরটি হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের ও যৌথ মালিকানাধীন রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট। সেই তালিকায় তৃতীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে উৎপাদনে আসলেও বেসরকারি মালিকানাধীন এটাই প্রথম বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাংলাদেশ বেসরকারি খাতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রথম ৩টি চুক্তি করে ২০১২ সালের জুনে। প্রথম দফায় সম্পাদিত ওই চুক্তিগুলো হয় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে। অন্যদিকে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এস আলম গ্রুপ চুক্তিবদ্ধ করে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ওরিয়নের বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসা তো দূরের কথা, কাজই শুরু করতে পারেনি। আর ৪ বছর পরে চুক্তি করেও অন্যদের পেছনে ফেলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে দেশখ্যাত এস আলম গ্রুপ। পুরো বিদ্যুৎ খাতের জন্য সুখকর বার্তা বয়ে এনেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। অন্যদের তুলনায় সাশ্রয়ী দামে মিলবে এখানকার বিদ্যুৎ। ভারতীয় কোম্পানি আদানী গ্রুপের কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্রের (আমদানিকৃত) বিদ্যুৎ, এমনকি বাংলাদেশ-চীন সরকারের যৌথ মালিকানাধীন পায়রার তুলনায় দাম সাশ্রয়ী হবে এই বিদ্যুৎ।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় প্রায় অর্ধেকের কম দামে পাওয়া যাবে বিদ্যুৎ। আর ডিজেলের সঙ্গে তুলনা করলে খরচ এক-তৃতীয়াংশ। বর্তমানে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে (টন প্রতি ১২৫ ডলার) ইউনিট প্রতি জ্বালানি খরচ ৬.৫০ টাকা, ফার্নেস অয়েলে (লিটার ৮৫ টাকা) ১৯ টাকা এবং ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ২৮ টাকার মতো খরচ পড়ছে। ফার্নেস অয়েলের সঙ্গে তুলনা করলে ইউনিটে সাশ্রয় হবে ১২ টাকার মতো। বাঁশখালী পুরোপুরি উৎপাদনে থাকলে দৈনিক প্রায় সোয়া ৩ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। মাসে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৯৫ কোটি ইউনিটের মতো। ইউনিট প্রতি ১২ টাকা হারে সাশ্রয় ধরলেও সরকারের সাশ্রয় হবে ১১৪০ কোটি টাকার উপরে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ২৭৫ মিটার উচ্চ রঙ্গিন চিমনী অনেক দূর থেকেও দৃশ্যমান। সাগর মোহনায় নির্মাণ করা হয়েছে বিশেষায়িত জেটি। যেখানে ঘণ্টায় ২ হাজার মে. টন কয়লা খালাস করা যাবে। কয়লা ইয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত দু’টি কনভেয়ার বেল্টের সক্ষমতা রয়েছে ৪ হাজার মে.টন। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে ঢাকনা যুক্ত কনভেয়ার বেল্ট বসানো হয়েছে। কয়লা ইয়ার্ডের চারপাশে দেওয়া হয়েছে উঁচু নেটের ঘেরা। দু’টি উন্নতমানের এফজিডি (ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন) নির্মাণ হয়েছে অনেক আগেই। অ্যাশ সংরক্ষণের জন্য ২টি সাইলে নির্মাণ করা হয়েছে যার প্রত্যেকটির ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ২ হাজার ৬’শ মে. টন। আর ৮০ একর জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে বিশাল অ্যাশপন্ড। সাইক্লোন কিংবা জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে হেভি ওয়েভ প্রাচীর।
বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষে বাঁশখালীর (চট্টগ্রাম) গন্ডামারা এলাকায় বৃহৎ ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। মালিকানায় রয়েছে দেশীয় খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ, চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচ টিজি। দেশীয় কোম্পানি এস আলমের অংশীদারিত্বের পরিমাণ ৭০ শতাংশ, আর চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচ টিজির হাতে রয়েছে ৩০ শতাংশ।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হওয়ার আগে থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি থেকে ট্যাক্স, ভ্যাট ও অন্যান্য ফি বাবদ প্রায় ১৩’শ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। দেশের ভেতর থেকে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছে। শুধু তাই নয়, করোনার মতো মহাসংকটের সময় যখন কর্মসংস্থান সংকট তৈরি হচ্ছিল, সেই সময়সহ টানা ৪ বছর ধরে ৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে। কেন্দ্রটিতে ১২’শ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিইআরসির সাবেক সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মাইলফলক। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভালো প্রচেষ্টা। একটা বড় বিনিয়োগ সফল হলে পেছনে অনেক বিনিয়োগকারী উৎসাহী হন। অর্থাৎ একটা বিনিয়োগ আরেকটি বিনিয়োগ ডেকে আনে। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল এর মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত গ্যাসের পরেই কয়লাকে সাশ্রয়ী বিবেচনা করা হয়। সে কারণে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। কেন্দ্রটি উৎপাদনে এলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ কমে আসবে। কিছুদিন আগে তেলের দাম বেড়ে গেল যখন বিদ্যুতের কিছুটা সংকট হয়েছিল, তখন টেস্টরানে এসে এসএস পাওয়ার ভালো সাপোর্ট দিয়েছে।