৫ অক্টোবর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যেদিন রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করা হবে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
এর মধ্যদিয়ে নিউক্লিয়ার ক্লাবের ৩৩তম গর্বিত সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পাবনার রূপপুরে চলছে সাজসাজ রব। ইতোমধ্যেই রূপপুরে পৌঁছে গেছে আংশিক ইউরেনিয়াম রড। প্রথম ইউনিট (১২০০ মেগাওয়াট) চালু করার জন্য ৭৫ টন ইউরেনিয়াম প্রয়োজন হবে। একবার জ্বালানি দেওয়ার পর ১৮ মাস নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এরপর এক-তৃতীয়াংশ ইউরেনিয়াম অর্থাৎ ২৫ টন তুলে সেখানে নতুন রড দিতে হবে। এরপর আবার ১৮ মাস চলবে। এভাবে ১৮ মাস পরপর আংশিক জ্বালানি পরিবর্তন করতে হবে।
এক কেজি ইউরেনিয়াম প্রায় ১০০ টন কয়লার সমান তাপ উৎপাদনে সক্ষম। আর একই পরিমাণ তাপ তেলে উৎপাদন করতে হলে ৬০ টন ডিজেল প্রয়োজন হবে। যে কারণে এ সহজে পরিবহনযোগ্য বিবেচনা করা হয়। এই জ্বালানি একবার লোড করে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ১৮ মাস বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ অন্য জ্বালানিতে পেতে হলে অনবরত সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হয়।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে রূপপুরে নেওয়া হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জ্বালানি ইউরেনিয়াম রড। এর আগে রাশিয়ার একটি কারখানা থেকে একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পারমাণবিক জ্বালানির এই চালান আনা হয়। রাশিয়ার নভোসিবিরস্ক কেমিক্যাল কনসেনট্রেটস প্ল্যান্টে (এনসিসিপি) এই জ্বালানি উৎপাদিত হয়। রূপপুরের জ্বালানি সরবরাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চুক্তিবদ্ধ রয়েছে রোসাটম।
পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিশাল কর্মযজ্ঞ পদ্মার পশ্চিমতীর ভেড়ামারা থেকেও দৃশ্যমান। আকাশে উঁকি দেওয়া কুলিং টাওয়ারগুলো কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঈশ্বরদী ইপিজেড থেকেও স্পষ্ট। প্রত্যেকটি টাওয়ারের উচ্চতা হবে ১৭৫ মিটার। পুরো এলাকাজুড়ে চলছে রাজ্যের ব্যস্ততা, কারো যেনো দম ফেলাবার ফুসরত নেই। রাতদিন বিরামহীনভাবে চলছে ভিশনারি প্রকল্পটির নির্মাণ যজ্ঞ।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন অনেকেই। শুধু পরমাণু ক্লাবে প্রবেশ নয়, রূপপুর যেমন কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পুরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। একইসঙ্গে এক ঝটকায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও কমিয়ে আনবে। বাংলাদেশের এই প্রকল্পে করোনাসহ বৈশ্বিক নানা সংকটে শঙ্কার আভা দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত সব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। অভিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে স্বপ্নের প্রকল্পটি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির খারাপ নজির থাকলেও মূল প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি না করে অনন্য নজির স্থাপন করতে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেছেন, নিউক্লিয়ার এনার্জি ক্লিন এনার্জি হিসেবে প্রমাণিত টেনকোলজি। আমরা যে অঞ্চলে বাস করি অনেক আগেই একে ক্লিন এনার্জি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য নিউক্লিয়ার এনার্জিকে বিবেচনা করা হচ্ছে। সারাবিশ্বে যে কার্বন নিঃসরণ হয় তার এনার্জি খাত থেকেই দুই-তৃতীয়াংশ।
বাংলাদেশের জিরো কার্বন নীতি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২১ সালে কার্বন নিঃসরণ হয়েছে ১০৬-১১০ মিলিয়ন টন। আমাদের একটি টার্গেট রয়েছে জিরোর দিকে যাবো। ২০৩০ সালের মধ্যে ২৬ মিলিয়ন টনের মতো কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে রূপপুরে ২৪’শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে বছরে ২০ মিলিয়ন টনকার্বন নিঃসরণ কমে আসবে। অর্থাৎ ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কার্বন নিঃসরন কমে আসবে শুধু রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে। আরও দুইটি পরমাণু বিদ্যুৎ করার কথা, যদি করা যায়, তাহলে সরকার শর্তহীন ভাবেই কার্বন ইমিশন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেছেন, ফুকুশিমার পর কোরক্যাচার টেকনোলজি যুক্ত করা হয়। এটি না করলে অনেক খরচ কম হতো, কোরক্যাচার বসিয়েছি শুধু জনগণের নিরাপত্তার কথা ভেবে। নিরাপত্তার প্রশ্নে কোন ছাড় দেওয়া হয়নি। জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। তিনটি প্রথম শ্রেণি না থাকলে এখানে কোন প্রকৌশলী নিয়োগ করা হয়নি। আমাদের ছেলেগুলো শূন্য থেকে দেখছে, দক্ষ হয়ে উঠছে। আমার একটি ভয় হচ্ছে তেলে ভাসমান মধ্যপ্রাচ্যে যখন পরমাণু বিদ্যুতে ঝুঁকে যাচ্ছে। আমরা ছেলেদের ধরে রাখতে পারি কিনা! বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে আমাদের শ্রমিকদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেবে।
১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচের এই প্রকল্পে নব্বই ভাগ টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। একই সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রূশ ঠিকাদার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ এ প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট এবং একই পরিমাণ বিদ্যুৎ দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ২০২৪ সালে উৎপাদন হওয়ার কথা। তবে রাশিয়ার উপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে জার্মান প্রতিষ্ঠান সিমেন্স কাজকে জটিল করে তুলেছে। সিমেন্স ২৩৩/৪০০ কেভি জিআইএস সাবস্টেশন সরবরাহ করার কথা ছিল। তারা সাব স্টেশন সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানালে নতুন ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছে চীনা কোম্পানিকে। তারা ২০২৩ সালের নভেম্বরে সরবরাহ করবে। অন্যদিকে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারছেন না। যে কারণে ১ বছরের মতো পিছিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৫ সালে উৎপাদনে আসতে পারে।
বর্তমানে পৃথিবীর ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। ১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে।