পরিত্যক্ত সাঙ্গু গ্যাস ফিল্ডের অবকাঠামো ব্যবহার করে ভোলার উদ্বৃত গ্যাস আনা সম্ভব। কাজটি করা গেলে দৈনিক ১০০মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আনা সম্ভব। যার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ ডলারের মতো।
পাইপলাইনের কারণে যতো দিন গ্যাস ভোলা থেকে আনা যাচ্ছে না, ততদিন এভাবে গ্যাস আনা যেতে পারে। পাইপলাইন হলেও এ পদ্ধতি বহাল রাখার প্রয়োজন হতে পারে, কারণ ভোলার নদী এবং বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেখান থেকে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্যাস আনা যাবে। ইন্দোনেশিয়া তাদের দ্বীপগুলোতে এভাবে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।
এ জন্য অভ্যন্তরীণ পাইপলাইন, জেটি নির্মাণ ও জাহাজের মাধ্যমে অ্যাসোসিয়েটেড গ্যাস সাঙ্গু ফিল্ডে ইনজেক্ট করতে হবে। সাঙ্গুতে গ্যাসক্ষেত্রে ৫০০ মিলিয়ন সক্ষমতার প্রসেস প্ল্যান্ট বেকার পড়ে রয়েছে। সেই প্রসেস প্ল্যান্টে গ্যাস পরিশোধন হয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে চলে যাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এই প্রযুক্তি কোন হাইটেক বিষয় নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এ পদ্ধতি অনুসরণের নজির রয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে কোন কাজ করলে, অবশ্যই সুফল পাওয়া যাবে। কোন কাজ কঠিন বা সহজও নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টা নেওয়া গেলে এ কাজটিকে করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স ১৯৯৩ সালে আবিষ্কার করে শাহবাজপুর (ভোলা) গ্যাস ফিল্ড। এরপর ২০০১ সালে মার্চে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দেন। আবিষ্কৃত গ্যাস সম্প্রসারণ, উন্নয়ন, উৎপাদন ও বিতরণের জন্যে প্রকল্প এবং লিংক প্রকল্প হিসেবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন দেন। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে।
প্রকল্প ও পাইপলাইন নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও মালামাল সংগ্রহের কাজ যখন চলমান। তখন একটি দমকা হাওয়ায় বাঁধার মূখে পড়ে প্রকল্পটি। তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি প্রকল্পটি বাতিল ও ক্রয়কৃত পাইপলাইনের মালামাল গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি জিটিসিএলকে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত দেন। ওই অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী সভায় সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহারের অনুরোধ বিফল হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন মহলে দরবার ও অনুরোধসহ মন্ত্রণালয়ে পত্র মারফত সিদ্ধান্ত টি বাতিলের অনুরোধ করলে মন্ত্রণালয় আমার প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। বহাল থাকে প্রকল্পটি।
বাপেক্স প্রয়োজনীয় পাইপ ও মালামাল সংগ্রহ করে ২ নম্বর কূপ খনন ও ১ নম্বর কূপ ওয়ার্ক ওভার করে। কিন্তু ১ নম্বর কূপে ওয়ার্ক ওভারের সময় গ্যাস ফ্লো না হলে রিপারফোরেশন করা হয়। হেলি বার্টন কর্তৃক লগিং ক্যাবল উঠানোর সময় উচ্চচাপে গ্যাস আসে এবং মুখে সার্ফেসে ৪ হাজার চাপ (পিএসআই) গ্যাস এসে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার সৃষ্টি হলে লোকজন পালাতে থাকে। রিগ মাস্ট (টাওয়ারের) উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল গ্যাস। কিছুটা ভয় পেলেও হাল ছাড়িনি সেই দিন। আমার নীচের কর্মকর্তাকে ডেকে এনে অনুরোধ করে তাকে দিয়ে তার টুলবক্স থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে কূপটির গ্যাস ফ্লো বন্ধ করি। কূপটি নিয়ন্ত্রণ ও ওয়ার্ক ওভারের পরে গ্যাস ফ্লো করতে গেলে কোন ফ্লো কূপ থেকে আসে না। পরবর্তিতে ওপেন ও শাট প্রসেস (মানুষের হার্ট সচলের জন্য বুকের চাপ) ১০দিন করার পর কূপটি ফ্লো করে। ওই প্রসেস জোন বাংলাদেশের মধ্যে উচ্চ ও টাইট ওয়েল সম্পৃক্ত বলে আমার ধারনা। ১ ও ২ কূপের জোন অব্যবহৃত অবস্থায় মোমের মত আঠা জাতীয় গ্রিস দ্বারা বন্ধ হয়েছিল। ১ নম্বর কূপে রিপারফোরেট করে হেলি বার্টন যখন কেবল নিয়ে উঠে আসছিল, তখন তার টুল আঠা যুক্ত হয়ে বল্ড ও পিষ্টন এফেক্টের কারণে গ্যাস ফ্লো নিয়ন্ত্রণহীন হয়েছিল।
আমরা যখন গ্যাস নিয়ে প্রস্তুত তখন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে পিডিবি নীরব নীতি গ্রহণ করে। ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাপেক্সের জায়গায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০০৯ সালের মে মাসে গ্যাস দ্বারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন সময় পেট্রোবাংলা মন্ত্রণালয় এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলি না করার জন্য নিরুৎসাহিত করলেও অফিসিয়ালি বাধা প্রদান করে নি।
পরবর্তীতে ভোলা শহরে ২০ কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়। আমি দেখলাম ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় গেলে বিষয়টি অনেক ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। সে কারণে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে তৎকালীন ভোলার পৌর মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আলোচনার পর কোন রকম ক্ষতিপূরণ ছাড়া পাইপলাইন নির্মাণের সম্মতি দেন। ভোলা ও সংলগ্ন দ্বীপ এলাকাগুলো গ্যাসের প্রধান উৎস মনে করে এক পাতার একটি লিফলেট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রদান করি, অত্র এলাকায় প্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও উৎপাদনের জন্য যা বার্তা চব্বিশে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কোন ইতিবাচক সারা পাইনি। প্রকল্পটি আরও একটি নজীর তৈরি করে। মোট বরাদ্দ ছিল ১৬২ কোটি টাকা, মাত্র ৮০কোটি টাকায় কাজ শেষ করা হয়। উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে ভোলায় আরও দুটি কূপ খননের জন্য কর্তৃপক্ষ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টার কাছে ধর্না দিয়ে কোন সাড়া পাইনি। পরে অব্যায়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত প্রদান করা হয়। প্রজেক্ট সমাপ্তির প্রতিবেদনে নতুন দুটি কূপ খননের সুপারিশ করি (শাহবাজপুর ৩ ও ৪)। পরবর্তীতে শাহবাজপুরে দু’টি, শ্রীকাইলে একটি, শেমুতাংয়ে একটি, বেগমগঞ্জে একটিসহ ৫টি কূপ খননের প্রস্তাব এমডি কর্তৃক অনুমোদন গ্রহণ করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্বারা মাত্র ১৫ দিনে কূপের লোকেশন নির্ধারণ করি, যা বাপেক্সের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অজ্ঞাত কারনে কর্তৃপক্ষ এই পাঁচটি কূপ গ্যাসপ্রম কে দিয়ে খনন করায়। গ্যাসপ্রম ভোলার বিস্তীর্ণ এলাকায় চারটি কূপ খনন করেছে। গ্যাসপ্রম ভোলাও তীরবর্তি দ্বীপে ১২টি কূপ খননের প্রস্তাব দেয়। বাপেক্স তিনটি কূপ অনুমোদন করলে সেখানে গ্যাস পাওয়া যায়। এই কাজের মাধ্যমে আমার লিফলেটের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে বলে আমি মনে করি।
ভোলার বিদ্যমান ৯টি কূপ থেকে দৈনিক ২’শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন যোগ্য হলেও বর্তমান মাত্র ৬০ মিলিয়ন উৎপাদন হচ্ছে। আপাতত ভোলায় কুপ খনন না করে অতিরিক্ত ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সাঙ্গু প্লাটফর্মের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিস সরবরাহের জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকার ভোলা থেকে ২৫ মিলিয়ন গ্যাস সিএনজি আকারে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। চুক্তিতে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির পরিবহন খরচ ধরা হয়েছে ৩০.৬০ টাকা। এরচেয়ে অনেক কম খরচে সাঙ্গু প্লাটফর্ম ব্যবহার করে গ্যাস আনা সম্ভব। এতে ঘনমিটারের খরচ ১০ টাকার নিচে থাকবে।
ভোলায় যখন উদ্বৃত্ত গ্যাস পড়ে রয়েছে তখন দেশের অন্যান্য অঞ্চলে চলছে গ্যাস চরম সংকট। সেই সংকট মোকাবেলায় বিদেশ থেকে চড়াদামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানিকৃত প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির জন্য গুণতে হচ্ছে ১৪ ডলারের মতো। সে হিসাব করলে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মূল্য দাঁড়ায় ১৪ লাখ ডলারের মতো। গ্যাসের পরিমাণ আরও বাড়ানো সম্ভব, এ জন্য ভোলার নদীগুলোর মধ্যেও গ্যাস কূপ খননের ও উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। এ কাজটি জরুরি ভিত্তিতে না করলে বিদেশি কোম্পানীগুলো আমাদের অভাবের সুযোগ নিতে চাইবে। এ বিশাল সম্পদটি বিবিয়ানার মত হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে৷
লেখক: মো: আমজাদ হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাপেক্স, প্রকল্প পরিচালক,শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্র মূল্যায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্প