অবিলম্বে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের ইনডেমনিটি (বিশেষ বিধান আইন) আইন বাতিল ও বিদ্যুতের দাম ঘোষণার এখতিয়ার বিইআরসির হাতে ফিরিয়ে দেওয়া দাবি জানিয়েছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
বুধবার (২৯ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে ক্যাব আয়োজিত জ্বালানি রূপান্তরে সুবিচার চাই শীর্ষক আলোচনা সভা থেকে এ দাবি জানানো হয়।
সভাপতির বক্তব্যে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি দ্রুত সরবরাহের জন্য আইনটি প্রথম দুই বছরের জন্য করা হয়। এরপর দুই বছর করে মেয়াদ বাড়ানো হয়, সর্বশেষ ৫ বছরের জন্য বাড়ানো হয়, এই কাজটি উচিত হয়নি। অবিলম্বে আইনটি বাতিল করা উচিত।
তিনি বলেন, ২০০৬-০৭ সালে কি অবস্থা ছিল, সেই সময়ে কুইক রেন্টাল ও ক্যাপাসিটি চার্জ যৌক্তিক ছিল, এখন আর প্রয়োজনীয়তা নেই। ভুল সবই ভুল হয়েছে আমি এর সঙ্গে একমত নই। সরকার যা করছে কিছু হয়নি, এই মত যারা পোষণ করেন তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। কিছু না হলে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছার কথা না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেন, জ্বালানি সংকটের মৌলিক জায়গায় নজর দিলে সমস্যাটা থাকে না। এই সংকটের মূল কারণ হচ্ছে অতি উচ্চমূলে এলএনজি, কয়লা আমদানি। এর বিকল্প যা ছিল সেদিকে নজর দেওয়া হয়নি।আমাদের যে ভূ-কাঠামো অনুযায়ী অনেক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেউ বলছে ৩২ টিসিএফ, কেউ বলছে ৪২ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার যাবে।
মৌলিক জায়গায় অতীত থেকে বর্তমান কোন সরকারেই যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। সাগরে প্রচুর গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানেও নজর দেওয়া হয়নি। যদি অনুসন্ধানের হার বলি তাহলে বছরে একটি করে কূপ খনন করা হয়েছে। প্রতিবছর ৫-৬টি কূপ খনন করা গেলে, এই সংকট থাকার কথা না। ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ৩টির প্রত্যেকটিতে গ্যাস পাওয়া গেছে ।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। প্রবৃদ্ধির জন্য বিদ্যুৎ জরুরি, তবে আমরা জনগণের কল্যাণে বিদ্যুৎ চাই। কারণ প্রবৃদ্ধি হলেই জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হয় না। আপনি যা তৈরি করলেন কিন্তু দাম মানুষের নাগালে না থাকে তাহলে তা সফল বলা যাবে না।
ইনডেমনিটি আইন করা হয়েছে যাতে চ্যালেঞ্জ করা না যায়। এই আইনটি বাতিল করতে হবে। বিইআরসিকে পুর্নবহাল করতে হবে। বিইআরসি সচল থাকলে এলিট দুর্নীতিবাজরা আটকে যায়, যে কারণে বিইআরসিকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যে চুক্তিগুলো করছি এগুলো কি প্রতিযোগিতামুলক হচ্ছে। প্রতিযোগিতামুলক না হলে স্বচ্ছতা থাকে না। সরকারকে সৌরবিদ্যুতের মনোযোগ বাড়াতে হবে। বেসরকারি খাত দিয়ে সম্ভব না। নো প্রফিট নো লস ফর্মুলায় সৌর বিদ্যুৎ হতে হবে।
ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, ন্যূনতম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আসছে ক্যাব। আমরা দেখতে পাচ্ছি ৩৩ কেভির ওপর লোডশেডিং হয়নি, নিচের দিকে ভয়াবহ লোডশেডিং দেওয়া হয়েছে। লাইফলাইন ট্যারিফের কথা বলা হয়, ৮ থেকে ১০ কিলোওয়াট ব্যবহারকারী ভোক্তার দাম ২৫ টাকার মতো পড়ছে। বলা হয় তাদেরকে কমদামে বিদ্যুৎ দিচ্ছি। আর বিলাসী ব্যবহারের জন্য ১১ টাকার মতো দিতে হয়। বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতকে বাণিজ্যিক করার ভয়াবহ প্রবাণতা দেখতে পাচ্ছি। অবশ্যই একে সেবাখাত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
এই খাতে সংকট হলে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত কঠিন হয়ে পড়বে। কৃষিকেও বাণিজ্যিক করার সর্বনাশা প্রবণতার আলামত দেখতে পাচ্ছি। ডোনারাদের প্রেসক্রিপশনে এগুলো করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্যাস-কয়লা রফতানি ঠেকাতে আমরা মাইলের পর মাইল লংমার্চ করেছি। নিজের সম্পদ থাকার সুবিধাটা পেলাম না, আমদানি করে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চলছে। আমরা একে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারি না।
শামসুল আলম কিছুটা আবেগ প্রবণ হয়ে বলেন, তিলে তিলে শেষ করা হচ্ছে, আমরা শুধু আফসোস করে যাবো। নতুন প্রজন্মের জন্য কেমন দেশ রেখে যাচ্ছি। আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, তোমরা এই অন্যায্যতা মেনে নিও না।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে যে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে, ২০১৯ সালে উৎপাদনে আসার কথা, এখন হয়তো এসেছে অথবা আসেনি। যতোদিন যাচ্ছে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে যাচ্ছে। অথচ সেই সময়ের ট্যারিফ (মূল্য) ১৬.৬০ টাকা এখন বহাল রাখা হয়েছে। তাদের থামানো না গেলে আতঙ্কিত হচ্ছি। আমার বিশ্ববিদ্যালেয় সৌর বিদ্যুৎ ৭.৫০ টাকায় হচ্ছে। ইউএসএআইডি বলেছে বাংলাদেশের রূফটপে ৫০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। যারাই গ্রিডের বিদ্যুতের নাম করে বিদ্যুৎ খাতকে ঝুঁকিতে ফেলেছে, তারাই আবার সৌর বিদ্যুতে নেমেছেন। এসব দুর্নীতি অনিয়ম রোধ করা জরুরি।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের দাম বিইআরসি নির্ধারণ করার কথা, সেখান থেকে আমলাদের ওপর নেওয়া হয়েছে। গণশুনানির ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম ঘোষণার এখতিয়ার বিইআরসির হাতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। এছাড়া ইনডেমনিটি বহাল রেখে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করতে হবে। যে সমস্ত অপরাধ ঘটতে তার বিচারের জন্য।
উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা বলেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে পঙ্গু করে রেখে রাশান কোম্পানিকে বিনা টেন্ডারে কাজ দেওয়া হচ্ছে। বাপেক্স যে কাজ ৮০ কোটি টাকায় করতে পারে সেই কূপ খননে ১৮০ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এনার্জি খাতকে তিলে তিলে ধ্বংস করা হচ্ছে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক ও জ্বালানি বিষয়ক গবেষক আরিফুজ্জামান তুহিন। তিনি, প্যারামাউন্ট গ্রুপের ১০০ মেগাওয়াট (পাবনা), বেক্সিমকো গ্রুপের ২০০ মেগাওয়াট (গাইবান্ধা) ও ইন্ট্রাকো পাওয়ার লিমিটেডের ৩০ মেগাওয়াট (লালমনিরহাট) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর গবেষণা তুলে ধরেন। তিনি দেখিয়েছেন, পাবনায় জমি কেনার আগেই জোর করে দখল নিয়ে সশস্ত্র পাহারা বসানো হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও ৩০ শতাংশ মালিক ক্ষতিপূরণ পান নি। গাইবান্ধায় পুলিশ দিয়ে জোর করে জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। কৃষকদের নামে ভুয়া চাঁদাবাজির মামলা করে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। জমি দখল ছাড়াও আরও অনেক অনিয়ম উঠে এসেছে। প্রকল্পের জন্য অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণের কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে লালমনিরহাটে।