মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের গ্যাস বিল বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তিতাসের গ্যাস বিল বাড়ানোর প্রস্তাব শিগগিরিই কমিশনের সভায় তোলা হবে বলে জানিয়েছেন বিইআরসি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন।
তিতাস গ্যাস বিদ্যমান দর এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) বাড়িয়ে ৭৬.৬৫ ঘনমিটার (১৩৭৯.৭০ টাকা) করা, দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৮৮.৪৪ ঘনমিটার (১৫৯১.৯২) করার আবেদন করেছে বিইআরসির কাছে। আবেদনটি চলতি বছরে মে মাসে জমা হয় বিইআরসিতে। ব্যাপক বিতর্কের পর বিষয়টি অনেকটা ধামাচাপা পড়ে যায়।
তবে সম্প্রতি বেশ গোপনে এ বিষয়ে আবার তৎপরতার শুরুর কথা জানা গেছে। বিইআরসির চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাইলে বলেন, আগে শুধু তিতাস গ্যাসের প্রস্তাব এসেছিল, যে কারণে পেট্রোবাংলার মতামত চাওয়া হয়। সম্প্রতি পেট্রোবাংলা মতামত দিয়েছে, এখন কমিশনের সভায় উঠবে আবেদনটি, সেখানে সিদ্ধান্ত হবে কি করা হবে না হবে।
গণশুনানি কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) ড. মোঃ হেলাল উদ্দিন বলেন, কমিশনের সভার আগে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। বিল বাড়ানোর কি যুক্তি দিয়েছে সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
বিইআরসি সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় গত বছরের ৫ জুন। বিইআরসি ও ঘোষণার আগে মার্চে গণশুনানি গ্রহণ করে। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটারের পরিসংখ্যানে দেখা যায় গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার ব্যবহার করছে। প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে এক চুলা ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৭৭.৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়।
বিইআরসির তৎকালীন (২০২২ সাল) সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪কমকে বলেছেন, আমারতো মনে হয় ৫০ ঘনমিটারের নিচে করা উচিত ছিল। প্রথমবার জন্য ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছিল। তখন শর্ত দেওয়া হয়, প্রিপেইড মিটার বসানো এবং পরবর্তীতে কমিয়ে আনার।
আপনাদের সময়ে আদেশটি হয়েছে। কীসের ভিত্তিতে এক ও দুই চলা যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, তাদের যে সাড়ে ৩ লাখ প্রিপেইড মিটার ছিল সেখানে দেখা গেছে গড়ে ৪৫ এর নিচে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রিপেইড মিটারের বিলের তথ্য দেখলেই বুঝতে পারা যায়। বিষয়টির জন্য রকেট সায়েন্স জানা দরকার হয় না।
জুনের ওই আদেশে আবাসিকে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বর্তমান দর ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা করা হয়। সে হিসেবে নন মিটার একচুলার ৯৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১০৮০টাকা করা হয়।
তিতাস দাবি করেছেন, নির্ধারিত পরিমাণের (৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার) চেয়ে মিটারবিহীন গ্রাহকগণ বেশী গ্যাস ব্যবহার করে। ফলে সিস্টেম লস বৃদ্ধি পেয়েছে। এক চুলা ৭৬.৬৫ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার আবেদন করা হয়েছে। বিইআরসি আগে যে আদেশ দিয়েছে তা বাস্তব সম্মত ছিল না।
গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা গেলে এই সংকট থাকে না। প্রথম দিকে গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে বেশ তোড়জোড় ছিল। এখন যতটা পারা যায় বিলম্বিত করার কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। প্রথম দিকে তারা মনে করেছিলেন আবাসিকে অনেক বেশি গ্যাস পুড়ছে, মিটার স্থাপন করলে তাদের রাজস্ব বেড়ে যাবে। কিন্তু লালমাটিয়া (২০১৬ সালে) এলাকায় প্রথম যখন মিটার বসানো হলো তার রেজাল্ট এলো উল্টো। দেখা গেল প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারীদের বিল আসছে দেড়’শ থেকে আড়াই’শ টাকা। যাদের মিটার নেই তাদের কাছ থেকে তখন বিল আদায় করা হচ্ছিল দুই চুলা সাড়ে ৪’শ টাকা।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পূর্বে বলেছিলেন, প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘনমিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রীর হিসেব ক্যালকুলেট করলে বৈধ ৩৮ লাখ আবাসিক গ্রাহকের মাসে সাশ্রয় দাঁড়ায় ১২ কোটি ৫৪ লাখ ঘনমিটার। যার পুরোটাই এখন চোরের পেটে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)২০১৮ সালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের দ্রুত করার আদেশ দেন। গ্রাহক যাতে নিজেরা মার্কেট থেকে মিটার কিনে স্থাপন করতে পারে সেই সুবিধা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সেই নীতিমালায় বলা হয়েছে গ্রাহক নিজের পছন্দমতো দোকান থেকে মিটার ক্রয় করে বিতরণ কোম্পানিতে জমা দেবেন। বিতরণ কোম্পানিগুলো পরীক্ষা করে গ্রাহকের আঙ্গিনায় স্থাপন করবে। তবে নানা জটিলতা দেখিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। কোম্পানিগুলো বাজারের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে মিটার কিনেই নিজেরাই স্থাপন করছে, তাও চলছে ঢিমেতালে।
বিইআরসি ২০২২ সালে প্রিপেইড মিটার সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করে। তাতে বলা হয় ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর গেজেটে পর্যায়ক্রমে সকল আবাসিকে প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয় বিতরণ কোম্পানিগুলোর গৃহীত ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নয়। নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে বলে কমিশন আশা করে।
কমিশন একটি পত্রিকার রিপোর্টের সূত্র চিঠিতে উল্লেখ করেছে, প্রি-পেইড মিটার স্থাপন কাজ শেষ হলে প্রতি চুলায় ৩৩ ঘনমিটার গ্যাস সাশ্রয় হবে। এতে বছরে ৫৩ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হবে। এমতাবস্থায় বিতরণ কোম্পানিসমুহের গৃহীত ব্যবস্থা কমিশনকে অবহিত করা জন্য বলা যাচ্ছে।