সংযম সাধনাই রমজানের অন্যতম লক্ষ্য। গোটা বিশ্বের এই মাসে জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে। দেওয়া হয় নানা রকমের ছাড়! অথচ রমজানে উলটো চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। যে-যেভাবে পারেন রমজানে পণ্যের দাম বাড়তি নেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকেন। ফলে প্রতিবছর রমজানে সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যায় অসাধু ব্যবসায়ীদের মাঝে।
বেশ কিছুদিন ধরে দেশের বাজারে পণ্যের দাম নিয়ে অস্থিরতা চলছে সাধারণ ক্রেতারা হিমশিম খাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে, রমজানকে সামনে রেখে দামের বিষয়টিও আলোচনায় আসছে। বর্তমান বাজারের পণ্যমূল্য দেখে রোজার কথা ভেবে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন মানুষ। তাদের মনে একটাই প্রশ্ন- রোজায় দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে তো? ক্রেতাদের দাবি, ঈদকে সামনে রেখে লাভের সঙ্গে লোভ যুক্ত হওয়ায় রোজায় বাড়ে পণ্যের দাম! তারা বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার দাবি জানান।
সাধারণত রমজান এলে, খেজুর, ছোলা, বুট, বেসন, গরম মসলা, চিনি, মরিচ, বেগুন, ডাল, পেঁয়াজ, গরুর মাংস, মাছ এবং শাকসবজি ফলমূল সহ সকল পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে বিপাকে পড়েন ক্রেতারা। যদিও এবার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইতিমধ্যে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুর রোজার এই আট পণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়, এসব পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি করা যাবে। এই সুবিধার সুযোগ থাকবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত ।
রোজা মাসে ইফতারে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার খেজুর। বাংলাদেশ খেজুর আমদানি করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। আমদানিকৃত খেজুরের মধ্যে বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায়- মেডজল, খুরমা খেজুর, দাপাশ, আজোয়া, বড়ই খেজুর, মরিয়ম, খালাস। এছাড়া তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া থেকে আসা ডালালা জাতের খেজুর সবচেয়ে জনপ্রিয়।
লন্ড্রি ব্যবসায়ী মোফাজ্জল জানান, রোজা ছাড়াও তিনি নিয়মিত বাসায় খেজুর খেয়ে থাকেন। খেজুর একদিকে যেমন অনেক শক্তি যোগায় অন্যদিকে ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে রমজান মাসে খেজুর দিয়ে ইফতার করা উত্তম।
তিনি বলেন, গত বছর রমজানে যে সাধারণ খেজুর কিনেছিলাম ২২০ টাকা করে কিন্তু এবার সেই খেজুর এখনি বাজারে ৩০০-৩৫০ টাকা চাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। সুতরাং রমজান মাস এলে যে কি হবে তা আল্লাহ ভালো জানে। মূলত লাভের সঙ্গে লোভ যুক্ত হবার কারণে রমজানে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পায়। সরকারের উচিৎ আরও বেশি বেশি মনিটরিং করা।
আরেকজন ষাটোর্ধ্ব ক্রেতা মো: আব্দুস সালাম জানান, তিনি নিয়মিত খেজুর কেনেন। কিন্তু বর্তমানে খেজুরের যে দাম তা আগে কখনো দেখেননি তিনি। দাম বাড়ার পিছনে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এবং ডলার সংকটকেই দায়ী বলে মানেন তিনি।
বিদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, সৌদি আরবে যে খেজুর দশ রিয়ালে বিক্রি হয় মানে বাংলাদেশি টাকায় ১৮০-২০০টাকায় সেই খেজুর দেশের বাজারে বিক্রি হয় ৪৫০-৬০০ টাকায়।
ঢাকায় মিরপুর-১, মিরপুর-১০ এবং শেওড়াপাড়ার কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে বাজারে বর্তমানে, খুরমা খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা কেজি যা আগে বিক্রি হতো ২০০-২২০ টাকা দরে। দাপাস জাতের খেজুর ৪৫০টাকা কেজি যা আগে বিক্রি হতো ২২০-২৫০ টাকা কেজি। রেজিস্ট বড়ই ৪৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে যা আগে ছিলো ৩০০-৩৫০ টাকা কেজি। এছাড়া মরিয়ম ৭৫০,খালাস খেজুর ৪০০, তিনিউশিয়া এবং আলজেরিয়া থেকে আসা ডালালা জাতের খেজুর ৫৫০টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং দামী জাতের খেজুর আজোয়া আগে ১০০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত রমজানের চাইতে এবার খেজুরের দাম এখনই অনেক বেশি। কেজিপ্রতি খেজুরের দাম এরই মধ্যে ১০০-১৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। তাই এবার রমজানে দাম আরও বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা আছে বলেও জানায় ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ গত বার সরকার খেজুরে ২৭০ টাকা কেজি প্রতি ভ্যাট ধরার কারণে খেজুরের দাম এতোটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
মিরপুরের ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন ফলমূল বিক্রি করতেন। তবে গত পাঁচ সাত বছর ধরে তিনি খেজুরের ব্যবসা করছেন। তার দাবি খেজুরের মূল্য বৃদ্ধির পিছনে শুধু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ দিলে হবে না। সরকারের এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, খেজুর প্রতিদিন এলসি হয়না। তার অভিযোগ মাসরুক জাতের খেজুর দশ কেজির বক্স ২৮০০-২৯০০ টাকা এনে এক সপ্তাহের মাথায় প্রথমে ৩০০টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও তারপর সেই খেজুর আবার ৩২০০ এবং তারপর ৪০০০ টাকা দরে তাকে কিনতে হয়েছে। এতে এখন তার খেজুর কিনতেই কেজিপ্রতি গুনতে হয়েছে ৪০০ টাকা করে।
এখন তার প্রশ্ন যদি ৪০০ টাকা দরে এক কেজি খেজুর কিনি তাহলে বিক্রি করবো কতো। দোকানের স্টাফ, বিদ্যুৎ বিল, লাইন ম্যানের চাঁদা, রাস্তার খরচ সবমিলিয়ে খেজুরের দাম পরে ৪৩০ টাকার বেশি। এক কেজি খেজুর বিক্রি করে যদি বিশ টাকা চল্লিশ টাকা লাভ না হয় তাহলে তো ব্যবসা গুটিয়ে বাসায় বসে থাকতে হবে। এরপর মালের মধ্যে পচা, ওজনে ঘাটতি সহ নানা রকমের সমস্যা রয়েছেই। এদিকে সংসার চালানোই এখন দায়। তার উপর ভোক্তা অধিদপ্তর এর লোকজন এসে জরিমানা করে। নানান সমস্যা।
আরেক ব্যবসায়ী কাওসার জানান, আমরা এক কেজি খেজুরের সর্বোচ্চ মেডজল বা আমবার জাতের খেজুর ৭০০০ টাকা থেকে কাটুন ১৪০০০ টাকায় কেনা পরলে ১৫০-২০০ থেকে লাভে বিক্রি করি।
এক কনটেইনার মাল মানে দুই কার্গো মালের ২০২২ সালে ছিলো ১৭ লাখ টাকা ভ্যাট। আর এখন ২০২৩ সালে ৫০ লাখ টাকা ভ্যাট ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। তাহলে দাম বাড়বে না কেনো?
রমজানে পণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে কারণ জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন বার্তা ২৪.কম’কে বলেন, রমজান মাস আসলে কিছু পণ্যের দাম বাড়ে। যেমন-খেজুর, ছোলা, ভোজ্য তেল ইত্যাদি। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে যদি সরবরাহের উন্নতি না হয় তাহলে দাম বাড়াটা স্বাভাবিক। সরবরাহ পরিস্থিতি যদি ভালো থাকে তাহলে দাম বাড়বে না।
তিনি আরও বলেন, একটা প্রবণতা আমরা অনেক সময় দেখি সেটি হলো, যারা বিত্তবান, যারা একসাথে বেশি জিনিস কিনেন, যাদের বাড়তি চাহিদা রয়েছে এটা পরিহার করা উচিত। যার যতটুকু প্রয়োজন শুধু ততটুকুই ক্রয় করা উচিত। একসাথে ১৫ দিন বা ১ মাসের জিনিসপত্র ক্রয় করা উচিত নয়। তবে বাজারে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুত থাকে সেদিকে সরকারের খেয়াল রাখা উচিত। একসাথে যাতে বেশি পণ্য না কিনে সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত বলে মনে করেন গোলাম রহমান।