ব্যাংকের হঠকারিতায় হুমকির মুখে বাঁশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহ। জটিলতা দূর করা না গেলে সাশ্রয়ী বিদ্যুতের অন্যতম ওই উৎসটি নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
মজুদ কয়লা দিয়ে সর্বোচ্চ ১২ দিন চলতে পারবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। আর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে নবগঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষে ঘাটতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে। বাঁশখালীতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে জ্বালানি খরচ হয় প্রায় ৭.৫৬ টাকার মতো। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ ফার্নেস অয়েল দিয়ে সরবরাহ দিতে গেলে জ্বালানি খরচ দাঁড়াবে প্রায় ১৮ টাকার মতো। ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরো মাত্রায় উৎপাদনে করলে মাসে প্রায় ৯৫ কোটি বিদ্যুৎ ইউনিট বিদ্যুৎ দিতে পারে। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ কয়লার পরিবর্তে ফার্নেস অয়েল থেকে পেতে হলে এক মাসে সরকারকে বাড়তি ৯৫০ কোটি টাকা গুণতে হবে। যা অন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হড়ে দাঁড়াতে পারে। শুধু আর্থিক দিক থেকে নয় কারিগরিভাবেও ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ বিকল্প উৎস থেকে সরবরাহ দেওয়া বেশ জটিল।
এসএস পাওয়ার ওয়ান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ট্যান ঝেলিং বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর থেকে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চলে আসছে।
কয়লা সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন রাখার জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে তিনটি জাহাজে প্রায় ১৬২,২০০ মেট্রিক টন কয়লা আনা হয়েছে। কয়লা বোঝাই জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে (যথাক্রমে ৩, ৭ ও ১২ আগস্ট থেকে) খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। কয়লা আমদানির পূর্বে শতভাগ মার্জিন দিয়ে এলসি খোলা হয়। তারপরও এলসির অর্থ ছাড় না করায় কয়লা খালাস করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হলেও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির কোন সাড়া মিলছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসএস পাওয়ারের নামে ওই ব্যাংকের কোন শাখায় কোন ঋণ নেই। শুধু ইসলামী ব্যাংক কেনো বাংলাদেশের কোন ব্যাংকে বাংলাদেশি টাকায় কোন ঋণ নেই। যেটুকু ঋণ রয়েছে সবটাই চায়না ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যাংকের দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প ঋণ। ইসলামী ব্যাংকের গুলশান সার্কেল-১ ব্র্যাঞ্চে চলতি হিসাব রয়েছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে রাজস্ব আদায় করা হয়। সেখানে এলসির বাইরে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকার মতো আমানত রয়েছে। সেই হিসাব থেকেও অর্থ ছাড় না করায় বৈদেশিক ঋণ কিস্তি পরিশোধ, কয়লা আমদানির জন্য নতুন এলসি খোলা, কাস্টম শুল্ক পরিশোধ এবং চাইনিজ প্রকৌশলীদের বেতন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে বহির্নোঙরে জাহাজ বসে থাকায় দৈনিক প্রায় ২০ হাজার ডলার জরিমানা গুণতে হচ্ছে। বারবার তাগাদা দিয়েও ইসলামী ব্যাংক গুলশান শাখা থেকে সাড়া না পেয়ে প্রধান কার্যালয়ে লিখিত আবেদন দেওয়া হয়েছে ১২ আগস্ট। তারপরও কোন সুরাহা করা হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর বরাবরে আবেদন দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে বাঁশখালীর (চট্টগ্রাম) গন্ডামারা এলাকায় বৃহৎ ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। মালিকানায় যুক্ত রয়েছে চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচ টিজি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অর্থায়ন এসেছে বিদেশি ব্যাংক থেকে, ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে রয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান। তারাই প্রকল্পের অপারেশন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন।
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের ফলে এ ধরণের বিদেশি বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ে গেলে দেশের ভাবমূর্তি সংকট দেখা দিতে পারে। ভবিষ্যতে নতুন কোন বিনিয়োগেও চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। যা দেশের জন্য কাম্য হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা অবিলম্বে পেশাদারিত্ব বজায় রাখার অনুরোধ করেছেন।
বিদ্যুৎ খাতসহ অনেক দিক থেকেই মাইলফলক হয়ে থাকবে বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বেসরকারি একক বিনিয়োগ হিসেবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড, আবার বেসরকারি প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগেও রেকর্ড করেছে এর মধ্যদিয়ে। বেসরকারি খাতে বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নেও রেকর্ড স্পর্শ করেছে সাশ্রয়ী খ্যাত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। ১.৭৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থায়ন এসেছে প্রকল্পটিতে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শুধু সরকারি মালিকানায় বড় আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। একটি হচ্ছে বাংলাদেশ-চীন সরকারের যৌথ বিনিয়োগে পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। অপরটি হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ মালিকানাধীন রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট। সেই তালিকায় তৃতীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে উৎপাদনে আসলেও বেসরকারি মালিকানাধীন এটাই প্রথম বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাংলাদেশ বেসরকারি খাতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রথম ৩টি চুক্তি করে ২০১২ সালের জুনে। প্রথম দফায় সম্পাদিত ওই চুক্তিগুলো হয় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে। ওরিয়নের বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসা দূরের কথা, কাজই শুরু করতে পারেনি। আর ৪ বছর পরে চুক্তি করেও বাঁশখালী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। অন্যদের তুলনায় সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় প্রায় অর্ধেকের কম খরচে পাওয়া যাবে বিদ্যুৎ। বর্তমানে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিট প্রতি জ্বালানি খরচ ৭.৫৬ টাকা, ফার্নেস অয়েলে ১৮ টাকা এবং ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ২৮ টাকার মতো খরচ পড়ছে। ফার্নেস অয়েলের সঙ্গে তুলনা করলে ইউনিটে সাশ্রয় হবে ১০ টাকার মতো।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রির মধ্যে বিশাল পার্থক্য সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে। যে কারণে সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।