রাশান কোম্পানি গ্যাজপ্রমের প্রেতাত্মারা পালিয়েছে, এখন সরব হয়ে উঠেছে কিছু ভূত। এখনও গ্যাজপ্রমকে বেশি দরে কাজ দিতে লবিং-তদবির চালিয়ে যাচ্ছে বলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
গ্যাজপ্রমের বাংলাদেশি এজেন্টরা দিনে দিনে দানবে পরিণত হয়েছিল। তাদের চাপে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বাপেক্সের প্রাণ যায়-যায় অবস্থা হয়েছে। বলা চলে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা রক্ষা পেয়েছে কোম্পানিটির। বাপেক্স যে কূপ ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকায় করতে পারে সেই কূপের জন্য পৌনে ৩০০ কোটি টাকার দর প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছিল গ্যাজপ্রম সিন্ডিকেট। দরপত্র ছাড়া বিশেষ আইনে দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো ছিল চোখে পড়ার মতো।
প্রস্তাবিত ১৫টি কূপে প্রতিটিতে ২৩ মিলিয়ন ডলার হারে (১২০ টাকা) প্রায় ৪২০০ কোটি টাকায় চুক্তি করতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। একই কাজ বাপেক্স দিয়ে সর্বোচ্চ ১২০০ কোটি টাকায় করা সম্ভব। যার ভুরিভুরি নজির বিদ্যমান, তারপরও চোখ বন্ধ করে ধারাবাহিকভাবে চড়া দরে কাজ দেওয়া হয়েছে।
এমনও সব নজির রয়েছে যা নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে অনেকের। তবুও সেই ভয়াবহ কাজ করে গেছেন তৌফিক ই-ইলাহী চৌধুরী সিন্ডিকেট। ২০১৪ সালে বাপেক্সের ৩৫৪তম বোর্ড সভায় শ্রীকাইল-৪ কূপ খননের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ৫৫৬তম বোর্ডসভায় ৬৪টি কোটি টাকার ডিপিপি (প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব) অনুমোদন করা হয়। অনুমোদিত ডিপিপি পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করে। নিয়ম হচ্ছে পেট্রোবাংলা অনুমোদন সাপেক্ষে কাজ শুরু হবে। কিন্তু পেট্রোবাংলায় ৬৪ কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন না দিয়ে ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি প্রেরণ করতে বলে। বাধ্য হয়ে একই কাজের জন্য ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি করা হয়। আর সেই কাজটি দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে।
বিভিন্ন সময়ে এভাবে কয়েকগুণ বেশি দরে ১৭টি কূপের কাজ দেওয়া হয়েছে গ্যাজপ্রমকে। আরও ১৫টি কূপ খনন প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বাপেক্সের ভোলা গ্যাসফিল্ডের ৫টি কূপ খনন প্রকল্প। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আরেকটি মিটিং হলেই চূড়ান্ত হতো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব নিয়েই বিশেষ আইনে প্রক্রিয়াধীন থাকা প্রকল্প স্থগিত করে দিয়েছেন। আর এতেই রক্ষা পেয়েছে বিশাল অংকের ঋণের বোঝা থেকে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, উন্মুক্ত দরপত্রের জন্য ফাইল রেডি করে রাখা হয়েছে। নির্দেশনা পেলে ১দিনের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হবে।
একদিকে ৮০ কোটি টাকার কাজ পৌনে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়, আবার যে কূপটি আরও কয়েক বছর পরে করা উচিত, সেই কাজ এখন করায় শুধু ঋণের বোঝা বাড়ছে, কোনো রিটার্ন পাচ্ছে না বাপেক্স। এভাবে অতীতেও বিপদগ্রস্ত করা হয়েছে বাপেক্সকে। আবারও তারই মহড়া চলছিল বিশেষ গোষ্ঠির স্বার্থে।
দ্বীপজেলা ভোলায় ৯টি কূপ রয়েছে, এগুলো থেকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। সেখানে গ্যাসের চাহিদা নেই, আবার মূল ভূখণ্ডে আনার পাইপলাইন না থাকায় দৈনিক মাত্র ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।
টবগী (২০১৭ সাল) ভোলা নর্থ (২০১৮ সাল) এবং ইলিশাসহ (২০২২ সাল) ৫টি কূপ এখনই বসে আছে। সেই ভোলায় দ্রুত সরবরাহ আইনে চড়া দরে ৫টি কূপ খনন প্রকল্প কার স্বার্থে গ্রহণ করছে এমন প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের স্বার্থ নয়, এই প্রকল্প রাশান কোম্পানি গ্যাজপ্রমের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। যখন গ্যাজপ্রমকে দিয়ে টবগী ও ভোলা নর্থ (বসে থাকা কূপ) খনন করা হয় তখনও আপত্তি উঠেছিল। তখন বলা হয়েছিল এসব কূপ এখন খনন করে কোনো লাভ নেই। তখন সংশ্লিষ্টদের এমন আপত্তি সত্ত্বেও কূপ দু’টি অস্বাভাবিক দরে খনন করা হয়। যা এখনও পড়ে রয়েছে।
খালি চোখে হয়তো অনেকে কূপ খনন করে রেডি রাখাকে সমর্থন করতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে এসব প্রকল্প থেকে কোনো রিটার্ন পাচ্ছে না বাপেক্স। উল্টো অগ্রিম চড়াসুদে ঋণে বাপেক্সে বিনিয়োগ সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। ২০১৭ সালে কূপ খনন করে ৪’শ কোটি টাকার বোঝা চাপানো হয়েছে বাপেক্সের কাঁধে।
বাপেক্স নিজে করলে সর্বোচ্চ ১২০ কোটি টাকায় করতে পারতো। সময় নিয়ে এখন এসে করলেও কোনো অসুবিধা হতো না।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ভোলার কূপ খননের বিষয়টি বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। নাইকোকে যেমন বিশেষ ব্যক্তিদের লাভ-লস হিসেব করে কাজ দেওয়া হয়েছিল, এখানে তেমনি হয়েছে। এখানে বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১০ টাকার কাজ একশ টাকায় দেওয়া হচ্ছে এমন অরাজকতার দৃষ্টান্ত বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গ্যাজপ্রমের বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী সব সময় সাফাই গেয়ে এসেছেন। এক সভায় প্রকাশ্য বলেছেন, আন্তর্জাতিক দরের তুলনায় অনেক কম মূল্যে কাজ দেওয়া হয়েছে গ্যাজপ্রমকে। অনেকে আমাদের অনেক টাকা সাশ্রয় হয়েছে। কথিত রয়েছে তার কারণেই বাধ্য হয়ে গ্যাজপ্রমকে কাজ দেওয়া হয়েছে। গ্যাজপ্রমের ফাইল ছাড়ার জন্য ফোনে নির্দেশনা দিতেন।
একসময় অনিরুদ্ধ নামের একজন দেশীয় এজেন্ট কাজ করতেন, তারপর রাশিয়ার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন মিয়া ছাত্তার, তিনি সামনে চলে আসেন। আর পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তেন আরও বেশি কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। কাগজে কলমে নাম নেই, কিন্ত তাদের চাপ আঁচ করতে পারতো পেট্রোবাংলা। যাদের চাপের কাছে অসহায় ছিল বাপেক্স, আবার কেউ কেউ কমিশনের লোভে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পন করেছিলেন। গ্যাজপ্রমের প্রেতাত্মারা পালিয়ে গেলেও ভোলায় এখনও বাপেক্সকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এক সময় দেশীয় গ্যাসফিল্ড থেকে দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হতো। মজুদ কমে যাওয়া, বর্তমানে কমবেশি ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত স্থবিরতা দেশকে চরম সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ১৯৯৫ সালের জাতীয় জ্বালানি নীতিমালা অনুসরণ করা হলে আজকে এই সংকট হতো না। ওই নীতিমালায় প্রতি বছরে মোট ৪টি করে অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা থাকলেও কোনো সরকারই তা মেনে চলেনি। তেল-গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা, সফলতা ও অনুসন্ধ্যান স্তর বিবেচনায় ব্যাপক ভিত্তিতে অনুসন্ধান করা হলে তেল-গ্যাস প্রাপ্তির আরও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
পেট্রোবাংলার কয়েক দশকের ঢিলেমির কারণে সমালোচনায় মুখর ছিলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তবে সেইদিন এখন বদলে যেতে শুরু করেছে। পেট্রোবাংলার খোলনচে বদলে গেছে বর্তমান চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারের সময়ে। চলমান ৪৮ কূপ খনন প্রকল্পের পাশাপাশি নতুন করে আরও ১০০ কূপ খনন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে ১১২ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে কমবেশি ৯৯টি। আর আগামী ৩ বছরে ৬৯টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এটাকে অনেকে উচ্চাভিলাষী মনে করলেও খুবই জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ১০টি কূপ খনন করে ১টিতে গ্যাস পাওয়া গেলে অর্থনৈতিকভাবে সফল মনে করা হয়। সেখানে বাংলাদেশে ৩টি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে একটি গ্যাস পাওয়া যায়। তারপরও বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে যেভাবে কাজ হয় নি। যে কারণে আজকের এই সংকট।
বিগত ১৫ বছর দেশের গ্যাস সেক্টরের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতে গেলে অপদস্ত হতে হতো। গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা বললেই তাকে থামিয়ে দিতেন তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী। তিনি এসব বক্তব্যকে তাত্ত্বিক বলে উড়িয়ে দিতেন। কয়েকমাস আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককে তিনি নাস্তানাবুদ করেন কথার বেড়াজালে। তার কারণে কেউ আর জোর দিয়ে কিছু বলতে সাহস পেতো না। সর্বশেষ ১০০ কূপ খনন নিয়েও নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিলেন। কিন্তু পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারের একরোখা মনোভাবের কাছে হার মানতে বাধ্য হন তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী।