পুঁজিবাজারে পরিকল্পিত দরপতন?

পুঁজিবাজার, অর্থনীতি

মাহফুজুল ইসলাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 04:45:51

 

ঢাকা: নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পুঁজিবাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ বিনিয়োগকারীদের। নতুন এ সংকটে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারির পর থেকে ১০ এপ্রিল (বুধবার) পর‌্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হাওয়া হয়েছে সাড়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা।

বাজার আরো খারাপ হবে এমন আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। ফলে সরকারও এ খাত থেকে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।

সালতা ক্যাপিটালের বিনিয়োগকারী আহাদ ইমতিয়াজ বুলবুল বার্তা২৪.কমকে অভিযোগ করেন,গত ডিসেম্বর থেকে ২৭ জানুয়ারি পর‌্যন্ত বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে চলে গেছে একটি চক্র। তাদের হাতে শেয়ার না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিত বিভিন্ন গুজব ছড়ায়। শুরু হয় পুঁজিবাজারে দরপতন। তার সঙ্গে যোগ হয় আইপিওতে আসা কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি। দু’টি ইস্যুর পাশাপাশি বাজারে প্রকাশিত হয় প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের তথ্য। আর তাতে বাজারে শুরু হয় চরম আস্থা ও তারল্য সংকট।

নাম না প্রকাশের শর্তে ইবিএল সিকিউরিটিজের এক ট্রেডার বার্তা২৪.কমকে জানান, এই ইস্যুকে সামনে রেখে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সমন্বয়ের (ব্যাংক এক্সপোজার লিমিট) সময়সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি কৌশলে বন্ড ছেড়ে নিজের ফান্ড বড় করার পরিকল্পনা করছে। তাদের দাবিগুলো অর্থমন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি আদায়ে বাজারে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি নিজেরা বিনিয়োগ থেকে বিরত রয়েছে।

৯ এপ্রিল ডিএসইতে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মো. নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বাজারে এখন আস্থা ও তারল্য সংকট চলছে। এই সংকট কাটাতে প্রয়োজন নতুন নতুন ফান্ড। আমাদের কাছে ফান্ড নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট বাড়ানো এবং নতুন করে বন্ড থেকে ফান্ড বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু সরকার সেগুলোর গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে আমরা বিনিয়োগ করতে পারছি না। অথচ ২০১৪ সালের পর থেকে এই ইস্যুটি জিইয়ে রেখে সুবিধা নিচ্ছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো।

মার্চেন্ট ব্যাংকের পাশাপাশি ব্রোকারেজ হাউজগুলো আসছে বাজেটে নিজেদের দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছে। সংগঠনটি আসছে বাজেটে ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেন পরবর্তী ক্রমহ্রাসমান হারে কর অবকাশের পরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে শতভাগ কর ছাড়, শেয়ার লেনদেনে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ কর থেকে শূন্য দশমিক শূন্য ১৫ শতাংশ করা এবং স্ট্যাম্প ডিউটি প্রত্যাহারে প্রস্তাব করেছে।

দাবি আদায় না হওয়ায় তারাও লেনদেন না করে হাত গুটিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী এবং প্রধামন্ত্রীর কার‌্যালয়ে পর‌্যন্ত তদবির করছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআরকে) চাপ দিচ্ছে যাতে তাদের দাবি আদায় হয়।

এছাড়া দুই পুঁজিবাজার ঢাকা ও চট্টগ্রাম এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষও আসছে বাজেটে ৫ কোটি টাকা স্বল্প মূলধনী কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে কর ছাড়, ট্রেজারি বিল ও বন্ড লেনদেনে কর অব্যাহতি, বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ আয়ের সীমা ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা, বহুজাতিক ও ব্লু-চিপ কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করতে তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করপোরেট কর হারের পার্থক্য ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব দিচ্ছে।

 

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) তথ্য মতে,গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর থেকে হঠাৎ পুঁজিবাজারে উত্থান শুরু হয়। চলে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর‌্যন্ত। এরপর ২৮ জানুয়ারি থেকে ১০ এপ্রিল পর‌্যন্ত মোট ৫০ কার‌্যদিবস লেনদনে হয়েছে। এতে ৩৪ কার‌্যদিবস দরপতন হয়েছে। আর তার অর্ধেক সময়ে অর্থাৎ ১৬ কার‌্যদিবস পুঁজিবাজারে উত্থান হয়েছে।

তাতে গত আড়াই মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হাওয়া হয়েছে ৫৩ হাজার ৫২৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকারও বেশি। এর মধ্যে ডিএসইর বিনিয়োগকারীরা হারিয়েছে ২৬ হাজার ৯১৭ কোটি ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকার মূলধন। অপর পুঁজিবাজার সিএসই থেকে পুঁজি হাওয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৬০৮ কোটি ৩৫ লাখ ৫ হাজার টাকা।

একই সময়ে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৬৭৭ পয়েন্ট। আর সিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ১ হাজার ২০৬ পয়েন্ট। ডিএসইতে লেনদেন ১ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে ২শ’ কোটি টাকার গড়ে চলে এসেছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, কৃত্তিমভাবে পুঁজিবাজারে দরপতন হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ অসত্য নয়। যদি তাই না হতো তবে প্রতিষ্ঠানগুলো কেন হাতগুটিয়ে বসে আছে?

তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও দায়ী। কারণ গত সাত-আট বছরে ভালো কোনো কোম্পানি বাজারে আনতে পারেনি। ফলে যেসব কোম্পানি আইপিও’র মাধ্যমে বাজারে এসেছে, প্রিমিয়ামে টাকা নিয়েছে, সেসব কোম্পানির শেয়ারের মূল্য তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুল রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে শেয়ারের দাম উত্থান-পতন দেখা বিএসইসির কাজ নয়। বাজারে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি না, তা আমরা নিয়মিত তদারকি করছি। কোনো অনিয়ম পেলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর