কপারটেকের অবাস্তব তথ্য তদন্তের নির্দেশ ডিএসই’র

পুঁজিবাজার, অর্থনীতি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 17:50:44

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা বিভাগকে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমটেডের অবাস্তব তথ্য যাচাই-বাছাই করে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে পরিচালনা পরিষদ।

ডিএসইর সর্বশেষ র্বোড সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কপারটেক প্রাথমিক গণ প্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। এখন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। কোম্পানিটি আইপিওতে আসার সময় এমডিসহ ২১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাসিক গড় বেতন ভাতা মাত্র ৭ হাজার টাকা এবং রাতারাতি পরিশোধিত মূলধন ১৫ গুণ বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু অবাস্তব তথ্য দেয়।

ডিএসইর ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) এবং গণমাধ্যমে আইপিওতে আসার সময় কোম্পানির প্রসপেক্টাসে দেওয়া অবাস্তব তথ্যেরে বিষয়টি বেরিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে এ উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসই পর্ষদ।

ডিএসইর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানিটির কারখানা ও অফিস সরেজমিনে পরিদর্শন এবং বিশেষ নীরিক্ষা করা হবে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন। তারপর যাচাই বাছাই করে সঠিক হলে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। আর তথ্য সঠিক না হলে আইপিও বাতিলের আবেদন জানানো হয়।

এ বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বার্তা২৪.কমকে জানান, পর্ষদ সভায় বেশ কিছু এজেন্ডার মধ্যে কপারটেকের বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা বিভাগকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পর্ষদকে জমা দিতে বলা হয়েছে। কার্যদিবস শুরু হবে আগামী রোববার (১২ মে) থেকে।

কোম্পানির অবাস্তব তথ্যগুলো হলো

দেশে এখন একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের নূন্যতম মুজরি ৮ হাজার টাকা। সেখানে এমডিসহ কপারটেকের ২১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাসিক গড় বেতন-ভাতা মাত্র ৭ হাজার ২১৭ টাকা। এমডিসহ শীর্ষ ছয় কর্মকর্তা বাদ দিলে বাকি ২০৬ জনের গড় বেতন মাত্র ৪ হাজার ৫৬০ টাকা।

শুধু বেতন-ভাতা নয়, কোম্পানির আইপিও প্রসপেক্টাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আদায়যোগ্য নগদ অর্থ এবং দেনার হিসাবে গরমিল রয়েছে। ঋণ পরিশোধের পরও সর্বশেষ ঋণস্থিতি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। ঋণ কমার পরও অস্বাভাবিকহারে সুদ পরিশোধ বেড়েছে। কোম্পানিটির রাজস্ব আয়ের তুলনায় (টার্নওভার) মজুদপণ্যের হিসাব অস্বাভাবিক বেশি।

কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ হিসাব বছরের শুরুতে আদায়যোগ্য নগদ অর্থ বা রিসিভেবলস ছিল প্রায় ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ওই বছরে পণ্য বিক্রি হয় ৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকার। পণ্য বিক্রি থেকে নগদ আদায় ৫০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। উপরন্তু অগ্রিম বিক্রি আরও প্রায় ৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এ হিসাবে ক্লোজিং রিসেভেবলস হওয়ার কথা ৯ কোটি ৮ লাখ টাকা। আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

একইভাবে আর্থিক প্রতিবেদনে দেনা হিসাবে ৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা দেখালেও কাঁচামাল ক্রয় এবং এর বিপরীতে পরিশোধ হিসাব করলে অঙ্কটা দাঁড়ায় ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন: অবাস্তব তথ্যে আটকে যাচ্ছে কপারটেকের তালিকাভুক্তি

কপারটেকের দেওয়া তথ্যে ২০১৬-১৭ হিসাব বছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৩৩ শতাংশ কমলেও সুদব্যয় বেড়েছে ২৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল প্রায় ৩৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তা নামে ২৬ কোটি টাকায়। কিন্তু আগের বছর যেখানে এ ঋণের বিপরীতে পৌনে ২ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করে, গত বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। একইভাবে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১৭ শতাংশ কমার বিপরীতে সুদ ব্যয় বেড়েছে ৪৬১ শতাংশ। সার্বিক হিসাবে ঋণ ২৬ শতাংশ কমলেও সুদ ব্যয় বেড়েছে ১৩৩ শতাংশ। এছাড়া লিজ ঋণ ৪৫ শতাংশ বাড়লেও সুদব্যয় বেড়েছে ৫ হাজার শতাংশ। অর্থাৎ একদিকে কোম্পানির ঋণ কমেছে, কিন্তু বেড়েছে সুদ পরিশোধের পরিমাণ। এ বৈপরীত্যের বিষয়ে কোম্পানি বা অডিটরের কোনো ব্যাখ্যা বা পর্যবেক্ষণ নেই।

দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সমাপ্ত হিসাব বছরের প্রতিটিতে বিক্রয় কার্যক্রমে খরচ মোট বিক্রির ৭৫ শতাংশ। বিক্রয় বাড়লেও কী করে প্রতি বছর খরচ ৭৫ শতাংশ হলো, তার ব্যাখ্যা নেই। কপারটেক প্রতি হিসাব বছর শেষে মজুদ পণ্যের যে দাম উল্লেখ করেছে, তাও অবিশ্বাস্য। গত হিসাব বছরে যেখানে মোট টার্নওভার ছিল ৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, সেখানে এর ইনভেনটরিজ ৩২ কোটি টাকার। ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে যেখানে টার্নওভার ছিল পৌনে ৯ কোটি টাকারও কম, সেখানে ইনভেনটরিজ ছিল পৌনে ১০ কোটি টাকার। মাঝের বছরগুলোর তথ্যও একই রকম। এমন তথ্য বলছে, কোম্পানিটি তার বাজার চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পণ্য উৎপাদন করছে, যা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।

কপারটেক আইপিওতে আসার মাত্র দেড় বছর আগে রাতারাতি পরিশোধিত মূলধন ১৫ গুণ বা ১৫০০ শতাংশ বাড়িয়ে ৪০ কোটি টাকা করেছে। এ সময়ে কোম্পানিটির কর পরবর্তী নিট মুনাফা বেড়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ আইপিওতে আসার লক্ষ্য নিয়ে অযথা শেয়ার বাড়িয়েছে।

২০১৪ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে আসা কপারটেকের মালিকপক্ষ নিজেদের শেয়ার বাড়ানোর পাশাপাশি প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় প্রায় ২২ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। এতে আইপিও-পরবর্তী সময়ে মালিকপক্ষের মালিকানা ৩০ শতাংশে নেমেছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর