দেনা শোধ না করায় কমানো হলো জিপি-রবির ব্যান্ডউইথ

ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-26 11:48:56

বার বার সময় ও তাগাদা দেওয়ার পরও সরকারের পাওনা প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা শোধ না করায় বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি আজিয়াটা লিমিটেডের ব্যান্ডউইথ কমিয়েছে বিটিআরসি।

বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) প্রতিষ্ঠান দু’টিকে আলাদা চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

দ্রুত সরকারের এ টাকা উদ্ধারে প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিলসহ আরো কঠিন পদক্ষেপ নেবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। চিঠিতে জিপির ব্যান্ডউইথ ৩০ শতাংশ আর রবির ব্যান্ডউইথ ১৫ শতাংশ কমানোর কথা বলা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠান দু’টির মধ্যে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোনের কাছে সরকারের পাওনা সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। পুঁজিবাজারের অ-তালিকাভুক্ত রবি আজিয়াটা লিমিটেডের কাছে পাওনা রয়েছে ৮৬৭ কোটি টাকা।

বিটিআরসির এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে প্রতিষ্ঠান দু’টি। এতে গ্রাহকদের ক্ষতি হবে উল্লেখ করে তারা ‘ব্যান্ডউইথ কমানোর সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনার দাবি’ জানিয়েছে। শনিবার (৬ জুলাই) বিটিআরসির কাছে আবেদনও করেছে তারা।

রোববার (৭ জুলাই) দুপুরে হোটেল সোনারগাঁওয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিটিআরসির কঠোর পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি। তিনি বলেন, ‘অমীমাংসিত পাওনা আদায় না করায় ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ সীমিত করা বেআইনি ও অযৌক্তিক। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’

ফোলি আরও বলেন, ‘বিটিআরসির পাওনা টাকার সমস্যা সমাধান আরবিটেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে চাই।’

তবে গ্রাহকদের কত ক্ষতি হবে তার কোনো তথ্য দিতে পারেনি গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ।

একই দিন বিকেলে রবিও সংবাদ সম্মেলন করে ব্যান্ডইউথ পুনরায় বিবেচনার দাবি জানিয়েছে। এ পদক্ষেপের ফলে গ্রামীণফোন ও রবির গ্রাহকরা চরম ভোগান্তিতে পড়বেন। ইন্টরনেটের গতি অনেক কমে যাবে। কল ড্রপও বেড়ে যাবে।

প্রতিষ্ঠান দু’টির সংবাদ সম্মেলনের পাশাপাশি বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারের পাওনা টাকা গ্রামীণফোনকে দিতে হবে। গ্রামীণফোন এ টাকা না দিলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘বকেয়া অর্থ পরিশোধ না করায় গ্রামীণফোনের লাইসেন্স বন্ধসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়েছে। সে ব্যবস্থার অংশ হিসেবে তাদের ব্যান্ডইউথ কমানো হয়েছে। ব্যান্ডইউথ কমানোর মধ্য দিয়ে গ্রামীণফোনকে বার্তা দেওয়া হলো যে বিটিআরসি বসে নেই, বিটিআরসি ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা আশা করি, গ্রামীণফোন পাওনা টাকা দিয়ে দেবে।’

বিটিআরসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘গ্রামীণফোনের কাছে যে ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওয়া যাবে, সেটি কিন্তু অনেকদিনের বকেয়া। সম্ভবত ২০০৮ বা ২০১০ সালের দিকে করা অডিটে তাদের কাছে তিন হাজার কোটি টাকার মতো পাওয়া যেত। এরপর ঘটনা হাইকোর্টে গেল। হাইকোর্ট আবার ফ্রেশ অডিট করতে বললেন। সেই অডিটে জানা গেল, তাদের কাছে পাওয়া যাবে ১২ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে বেশ কিছু অংশ বিটিআরসির, এক তৃতীয়াংশ এনবিআরের এবং প্রায় এক তৃতীয়াংশ ১০ বছরের সুদ।’

‘এরপর টাকা তোলার জন্য সভা ডাকা হয়। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এ টাকা তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিল করা হবে। কিন্তু আমরা লাইসেন্স বাতিল না করে গ্রামীণফোনকে নোটিশ দিলাম। এরপরও টাকা না দেওয়ায় সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে তাদের ৩০ শতাংশ ব্রান্ডইউথ কমানো হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।

উল্লেখ্য, নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দুই অপারেটরের কাছে ১৩ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা পাওনা দাবি করছে বিটিআরসি। আর তাতে বারবারই নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে অপারেটররা প্রশ্ন তুলে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে অপারেটরদের চিঠি চালাচালির মধ্যেই এ কড়া পদক্ষেপ নিল সংস্থাটি।

গ্রামীণফোনের সার্ভিসে সাধারণ গ্রাহকরা এমনিতেই ত্যক্ত-বিরক্ত। সেবার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তাদের। খোদ ঢাকা শহরেই ফোরজি সার্ভিস পাওয়া যায় না। ইন্টারনেট একবার যায়, একবার আসে। কখনো কখনো নেটওয়ার্ক টুজিও হয়ে যায়। আর কলড্রপের অবস্থা তো আরো খারাপ। একটি কলে টানা পাঁচ মিনিটও কথা বলা যায় না। এখন নতুন করে বিরক্তি যোগ হয়েছে যে কারো সঙ্গে কথা বলার মধ্যে গান বেজে ওঠে। কল সেটআপ (নম্বর ডায়াল করার পর আরেকটি ফোনে ঢুকতে যে সময় লাগে) টাইমও বেশি গ্রামীণফোনের। এখন ৩০ ভাগ ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেওয়ার ফলে গ্রাহকদের দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গ্রামীণফোনের ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পাওনা দাবির মধ্যে বিটিআরসির পাওনা ৮ হাজার ৪৯৪ কোটি ১ লাখ টাকা। বাকি ৪ হাজার ৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা পাওনা এনবিআরের। সম্প্রতি মোবাইল ফোন নম্বর গ্রাহকের অজান্তেই আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগে গ্রামীণফোনকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানাও করে বিটিআরসি।

এছাড়া সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার বা এসএমপির অংশ হিসেবে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বিটিআরসি। অন্য অপারেটরদের যেখানে সর্বনিম্ন কলরেট ৪৫ পয়সা, সেখানে গ্রামীণফোনের সর্বনিম্ন কলরেট হবে ৫০ পয়সা। আন্তঃসংযোগ ফি (এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটর) অন্য অপারেটরদের যেখানে ১০ পয়সা, সেখানে গ্রামীণফোনকে দিতে হবে ১৫ পয়সা। এমনকি অন্য অপারেটরদের প্যাকেজের অনুমোদন নিতে না হলেও গ্রামীণফোনকে এখন থেকে সব প্যাকেজ অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে বিটিআরসি থেকে। মোবাইল ফোন নম্বর পোর্টেবিলিটির (এমএনপি) ক্ষেত্রে যে কোনো অপারেটরে গেলে ৯০ দিন সেখানে থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো গ্রাহক ৬০ দিনের মধ্যেই গ্রামীণফোন ছাড়তে পারবেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর