দিনে দিনে নিঃশেষ হচ্ছে পুঁজিবাজার!

পুঁজিবাজার, অর্থনীতি

মাহফুজুল ইসলাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা | 2023-08-26 12:52:39

দরপতন পিছু ছাড়ছে না দেশের শেয়ারবাজারের। টানা পতনে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। নতুন অর্থবছরের বাজেটে প্রণোদনার পাশাপাশি নানামুখী পদক্ষেপ ও আশ্বাসের পরও দরপতন থামছে না।

নতুন এই দরপতনে ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। আর তাতে লাভের পরিবর্তে বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়েছেন ৪১ হাজার কোটি টাকার। চরম হতাশায় গত ১১ কার্যদিবসে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন প্রায় ১ লাখ বিনিয়োগকারী।

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ প্রশ্নবিদ্ধ কোম্পানিকে পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিওর) ও রাইট শেয়ার ছেড়ে টাকা উত্তোলনের জন্য অনুমোদন দেওয়ার পাশাপাশি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার যোগসাজশে শেয়ার কারসাজি করায় ব্যাংক খাতের মতই পচে গেছে পুঁজিবাজার।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজার নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু লোকের হাতে জিন্মি হয়ে আছে। এখানে কোনো সুশাসন নেই। এখানে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। এটা আর ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

ইবিএল সিকিউরটিজের বিনিয়োগকারী সজল সাইদ রিপন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে অভিযোগ করে বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকারেজ হাউজ এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার লোকেরাই দুর্নীতি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। তারা পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে চায় না। বরং ইউনাইটেড এয়ার, কপারটেক, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজসহ যেসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব নেই, সেসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে উৎসাহিত করছে। এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হাওয়ার ২-৩ বছর পর থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে চলে যাচ্ছে। লাভের আশায় বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

লঙ্কা বাংলা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী মুনশি আহাদ আলী বলেন, পুঁজিবাজার পচে গেছে। এটা আর ভালো হবে না। তার কারণ এখানে গত ৮-৯ বছরে যেসব কোম্পানি লিস্টেড হচ্ছে, সবগুলো খারাপ। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের চরম দুরাবস্থার পাশাপাশি পিপল লিজিং কোম্পানির অবসায়নের ঘোষণার পর আর্থিক খাতের প্রতিও বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার মত কোম্পানি খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারে উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে বাজারে আস্থা ও তারল্য সংকট দূর করা। কারণ, এখন খারাপ কোম্পানির শেয়ারের কারণে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দামও পাল্লা দিয়ে কমছে। দেশীয় বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি বিদেশিরাও পুঁজিবাজার ছেড়ে পালাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে পুঁজিবাজারই ধ্বংস হয়ে যাবে।

বাজারের সার্বিক চিত্র:
চলতি অর্থবছরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে মোট ১১ কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৮ কার্যদিবস সূচক কমেছে আর ৩ কার্যনদিবস সূচক বেড়েছে। ফলে ডিএসইর প্রধান সূচক ৩৩০ পয়েন্ট কমে ৫ হজার ৯১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। যা গত আড়াই বছর আগের অবস্থানে ফিরেছে। আর তাতে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমেছে ২১ হাজার ৭৫ কোটি টাকার বেশি।

চট্টগ্রামের পুঁজিবাজারে সূচক কমেছে ১ হাজার পয়েন্ট। বিনিয়োগকারীদের মূলধন কমেছে ২০ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা।

পুঁজিবাজার ছেড়েছেন দেড় লাখ বিনিয়োগকারী:
শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য মতে, লাভের পরিবর্তে নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সবশেষ ১৫ দিনে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন প্রায় দেড় লাখ বিনিয়োগকারী। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ছিলো ২৮ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি। কিন্তু সেখান থেকে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার বিও হিসাব কমে ১৫ জুলাই দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৭ হাজারে।

দরপতনের প্রতিবাদে এবং বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে মতিঝিলের রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি ১০ হাজার কোটি টাকার ফান্ড গঠন ও নতুন করে কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন দেওয়া বন্ধ রাখার দাবি জানাচ্ছেন তারা।

বিনিয়োগকারী ঐক্য পষিদ নেতা আতাউল্লাহ নাইম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, পুঁজিবাজার এখন মুমুর্ষু অবস্থায় রয়েছে। পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা এখন দোলাচলে রয়েছেন। প্রত্যক দিন পতন হচ্ছে, আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি।

আইসিবি এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো আস্থা ও তারল্য সংকট দূরের লক্ষ্যে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের সুবিধাগুলো আদায়ে ব্যস্ত তারা, বাজারকে সাপোর্ট দিচ্ছে না।

ডিএসই’র সাবেক প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারের প্রতি এমনিতেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। তারপরও ব্যাংক খাতের নানা অনিয়মের পর এবার আর্থিক খাতের পিপল লিজিংয়ের অনিয়ম ধরা পড়েছে। ফলে এই সেক্টরের কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমেছে। এছাড়াও প্লেসমেন্ট শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানিগুলোর কারণে দিনে দিনে নিঃশেষ হচ্ছে পুঁজিবাজার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর