বিদেশী কর্মীর অর্থ নিয়ে যাওয়া বন্ধে শিক্ষাই বড় হাতিয়ার

, অর্থনীতি

খুররম জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-27 00:17:55

বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মী প্রতিবছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠায়। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশে যে সব বিদেশি কাজ করেন তারাও এদেশ থেকে বিশাল পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যান।

তবে তফাত হল বিদেশিদের বেতন বাংলাদেশিদের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। বিশ্বের কোনো দেশে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশিরা সে দেশের স্থানীয়দের চেয়ে দু’তিন গুণ বেশি বেতন পাওয়াতো দূরের কথা ন্যায্য পাওনাটাই পায় না।

এ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সম্প্রতি প্রাক বাজেট আলোচনায় এক বক্তব্যে জানান, বিদেশি কর্মীরা এ দেশ থেকে বেশ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিবছর নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ভিতরে থেকে তৈরী পোষাক শিল্পে বিভিন্ন চাকুরি করেই এ অর্থ নিয়ে যায়। কারণ বিশ্ব বাজারে আমাদের পণ্য বিক্রিতে দরকষাকষি করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ লোকবল নেই। তারা এখাতেই খুব কম লোক খাটিয়ে বেশী মুদ্রা নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে।

তিনি সরকারের পক্ষ থেকে আসন্ন বাজেটে এ বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন। এর সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রফতানীকারক কোম্পানিগুলোকে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠা গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ৮৫ হাজার। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি, অতএব তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেশি। বাংলাদেশে কাজ করা শুধু ভারতীয়রাই বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা দেশে নিয়ে যান বা দেশে পাঠান।

তবে উদ্বেগের বিষয়, বহু বিদেশিই আছেন যারা নিয়মানুযায়ী ওয়ার্ক পারমিট ছড়াই এখানে কাজ করেন। এ হিসেব সরকারের কাছে থাকাও কষ্টকর। কারণ এ নিয়ে মনিটরিং করার মত লোকবল বা প্রচেষ্টা দেশে নেই বললেই চলে।

২০১৭ সালের অক্টোবরে উপস্থাপিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিদেশি কর্মীরা ৫শ’ কোটি ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। ঐ প্রতিবেদনে কারণ উল্লেখ করে বলা হয় যে দেশের শ্রম শক্তিতে দক্ষতার অভাব রয়েছে, আর সেই দক্ষতার অভাব পূরণ করা হচ্ছে বিদেশিদের দিয়ে।

সব থেকে বেশি বিদেশী কর্মী কাজ করেন পোশাক খাতে। পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান যেমন গার্মেন্ট, কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং কোম্পানি মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ বিদেশী কাজ করেন এ দেশে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন কোম্পানি, পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি, মিডিয়া রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনী সংস্থাসহ বিদেশীরা কাজ করছেন সাধারণ ফার্নিচারের দোকানেও।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে সব মিলিয়ে প্রায় ৫৫টি দেশের নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেন। তাদের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। বিভিন্ন ধরনের চাকরিতে ভারতীয়দের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ভারতে পঞ্চম রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বিবেচিত। গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদে দেয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে মাত্র ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি চাকরি করেন। তার মধ্যে অর্ধেক ভারতীয়। বাংলাদেশে বৈধভাবে কাজ করতে হলে বিনিয়োগ বোর্ড থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ড থেকে যেসব কর্মী ওয়ার্ক পারমিট নিয়েছেন, তার বাইরে বহুগুণ বিদেশি এ দেশে কাজ করে। আর তাদের অর্জিত অর্থ অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমেই পাচার করা হয়ে থাকে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জানান, সাধারণ ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের নাগরিকরা এ দেশে আসেন। এ দেশের নাগরিকরা সহজেই বাংলাদেশে ভিসা পেয়ে যান। এর অন্যতম কারণ তাদের দেশের প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশি যান। তবে তফাত হল বাংলাদেশিরা যান নিখাদ ভ্রমণে আর তারা আসেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আয় করার জন্য।

এরপর তারা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ভিসার মেয়াদ শেষের আগেই চলে যান। নতুন করে আবার ভ্রমণ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান এসব বিদেশী কর্মীর বেতন পরিশোধ করেন কিন্তু তাদের ইনকাম টেক্সও কেউ দেয় না।

বিদেশী কর্মীরা ডলার করে টাকা নিয়ে যান নিজের দেশে।’ দেশে প্রায় সাড়ে বর্তমানে ৪ কোটি মানুষ বেকার, সে দেশে এসে বিদেশীরা কিভাবে বছরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায়। এত বেকার থাকতে দেশে কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব। বহু কাজ আছে যা বিদেশিরা ছাড়া করতে পারছে না বাংলাদেশ।

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী পড়ানো হয় না। এ নিয়ে বিশেষ চিন্তা বা পরিকল্পনাও দেখা যায় না। নেই নীতিমালা। সার্টিফিকেট দিতে ও পেতেই এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কর্মকাণ্ড হয়ে দাড়িয়েছে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন ২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র ৫ লাখ। বাকি ১৫ লাখ থাকে বেকার। এদের নিয়ে যথার্থ পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে দেশ দুপা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে যাবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর