বাজেটে মানবিক উন্নয়ন ভাবনা

, অর্থনীতি

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-15 06:51:26

দারিদ্র বিমোচন, অসমতা হ্রাস এবং জনগণের জীবনমানের মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তনই বাজেট প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য। বাজেট শুধু জিনিস-পত্রের দাম বাড়া কমার ফিরিস্তি নয়। বাজেটের সাথে মানবিক উন্নয়নের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সুখী, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এটি সরকারের উন্নয়ন ভাবনা ও একইসাথে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাও।

২০১৪ সালের নির্বাচনে এরকম একটি লক্ষ নিয়েই সরকার কাজ শুরু করেছে। সব সূচনে ইতিবাচক না হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই সরকার সফল। তবে উন্নয়ন অবকাঠামোর পাশাপাশি মানবিক উন্নয়ন বিষয়টিও আমাদের একইভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। এবারের বাজেটে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে মানবিক উন্নয়নের দিকটি নানাভাবেই এসেছে। বাস্তব কারণেই তার সবকিছু এখানে উল্লেখ করা সম্ভব না।

উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়ে সরকার ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দুটি পঞ্চ-বার্ষিকি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যা এখনও বাস্তবায়নাধীন। দেশকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়তে সরকার রূপকল্প ২০২১ তৈরি করেছে। সে রূপকল্পমতো সরকার তার উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একই ধারাবাহিকতায় সরকার ‘রূপকল্প ২০৪১’ও তৈরি করেছে যা আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা সাপেক্ষে কার্যকর হবে।

মাননীয় অর্থমন্ত্রী তার সরকারকে ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নের সুযোগ দেয়ার জন্য জনগণের কাছে আবেদন করেছেন। অনেকেই হয়তো এটিকে নির্বাচনী বাজেট হিসেবে দেখবেন। রাজনৈতিক বক্তব্যের মারপ্যাচে বাজেট নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা কমই হয়।

সরকারের অনেক মন্ত্রীই গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে একে অপরের সহায়ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

গণতন্ত্র ও ‍উন্নয়ন যে একে অপরের বিকল্প না, বরং সহায়ক শক্তি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে সে কথাই উঠে এসেছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত  করতেই প্রয়োজন গণতন্ত্র ও সুশাসন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করার সাথে সাথে একে সুসংসহ করা এবং উন্নয়নের সুফল সমাজের সর্বস্বরে পৌঁছানো জন্য প্রয়োজন মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও সুশাসন। অর্থমন্ত্রীর এরকম বক্তব্যে আমরা গণতন্ত্র সম্পর্কে আশান্বীত হই। তার এ বক্তব্য দেশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ভূমিকারই প্রতিধ্বনি।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার বদ্ধ পরিকর। ছোট দেশ কিন্তু অধিক জনসংখ্যা। এরকম একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনসংখ্যার চাপ। আমরা রাজনৈতিক বক্তব্যের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে জনসংখ্যাকে বোঝা না বলে জনসম্পদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। এটি তখনই সত্যি যখন জনসংখ্যাকে জনসমপদে রূপান্তরিত করা যায়। কিন্তু আমরা জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হইনি। এ বাজেটে জনসংখ্যাকে জনসম্পকে পরিণত করার জন্য দৃশ্যমান কিছু কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি বড় নিয়ামক হচ্ছে নিয়ম ও পদ্ধতির অনুসরণ ও সে মতো রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা। একটি দূর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামোতেই সেটি সম্ভব। কারণ, একটি দুর্নীতিযুক্ত সমাজে কোনো সিস্টেমই কাজ করেনা। তবে এর ভেতর দিয়েও আমরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছি। দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না। জনগণকে সাথে নিয়েই এ কাজটি করতে হয়।

সুশাসন, মানব উন্নয়নের একটি বড় হাতিয়ার হতে পারে ডিজিটালাইজেশন। এটি শুধু একটি শ্লোগান নয়, এটি সময় ও যুগের দাবী। দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করতে ডিজিটালাইজেশনকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী যথাথই এটিকে সংস্কারে একটি কর্মকৌশল হিসেবে দেখছেন।

তবে তিনি সংস্কার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কতিপয় আইন প্রণয়নের কথাও বলেছেন। আইন প্র্রণয়ন সংস্কারের মূল সূচক-এটি একটি আমলাতান্ত্রিক ধারণা। আইন দিয়ে সংস্কার করা যায় না, বরং সংস্কারই আইন প্রণয়নের প্রণোদনা সৃষ্টি করে। যাই হোক-সরকারের এক দশকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইনের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন; যেমন নিরাপদ খাদ্য আইন, নীতি ও বিধিমালা, ভোক্তা অধিকার আইন, সাধারণ ভবিষ্য তহবিল বিধিমালা, প্রতিযোগিতা আইন, এমএলএম বিষয়ক আইন, ট্রেডিং করপোরেশন আইন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো আইন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ইত্যাদি।  

ডিজিটাল বাংলাদেশ এই সরকারের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার। ক্ষমতায়নের একটি বড় উপায় হচ্ছে ডিজিটালাইজেশন। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন সম্ভব। রাষ্ট্র্রের অনেক সেবাই এর মাধ্যমে মানুষের দোড়গোড়ায় পৌছে দেয়া সম্ভব।

সেজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠানো নির্মাণ ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু ডিজিটালাইজেশন মানে শুধু জেলা উপজেলা পর্যায়ে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল স্থাপন নয়। দেশে ৮ হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল স্থাপনের মাধ্যমে মানুষের দোড়গোড়ায় তথ্য-প্রযুক্তি সেবা প্রদান সম্ভব নয়। সে জন্য সরকারের জনমুখী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমাল প্রয়োজন। এটিকে সরকারের রাজস্ব আয়ের উ]স হিসেবে বিবেচনা না করে বরং মানুষের ক্ষমতায়ন ও সর্বস্তরে সুশাসনের একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন, তবেই তথ্যপ্রযুক্তির সুফল মানুষ ভোগ করতে পারবে। প্রান্তিক ভোক্তা ও সেবাদাতাদের জন্য এ খাতে বাণিজ্য না হলেও টিকে থাকার উপায় নির্ধারণও জরুরি।

প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার প্রসারে আমাদের অগ্রগতি আছে। কিন্তু জীবনমানে মৌলিক পরিবর্তনের জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন তা এখনও সম্ভব হয়নি। সময়োপযোগী শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ আমাদের নেই। সে জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। উন্নত শিক্ষাই উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনের রূপকার। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তা শিক্ষার ওপর জোড় দিয়েছেন। তিনি উপবৃত্তি, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম বাড়ানো কথা বলেছেন। এটি শুভ  উদ্যোগ।

৭ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬৫ হাজার শ্রেণীকক্ষ, ১০ হাজার ৫০০ জন শিক্ষক ও ৩০ হাজার খেলার সামগ্রী বিতরণের যে কথা তিনি বলেছেন তা প্রশংসার দাবী রাখে। সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ভিত্তিক আইসিটি সেন্টার গড়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে আগামী প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করবে। মাধ্যমিক পর্যায়েও সরকার একইভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রমে প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর জোড় দেয়া হয়েছে। নতুন করে ২৬ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪৬ হাজার ৩৪০টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ ও ২ হাজার ১২০টি স্মার্ট শ্রেণিকক্ষ তৈরি কার্যক্রম হাতে নেয়ে হয়েছে।

দেশে প্রায় প্রতিবছর ২০ লক্ষ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। তাই শ্রমমুখী শিক্ষা প্রয়োজন। অনেকেই অভিবাসী হয়। ফলে তাদের জন্য কারিগরী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোড় দেয়া হয়েছে। সারা দেশে ১০০টি উপজেলায় ১টি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ৩৮৯টি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রও গড়ে তোলা হবে। এতে করে, দেশে ও দেশের বাইরে গড়ে উঠবে একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী। এরাই আগামী বাংলাদেশকে পথ দেখাবে। শিক্ষার মতো স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মানব কল্যাণের অনেকগুলো প্রকল্পই এ বাজেটে গুরুত্ব পেয়েছে যা বাস্তবায়ন হলে মানব উন্নয়নে আমরা আরো এগিয়ে যাবো।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর