‘বিশ্বাসের ঋণ’ দিয়ে ফেঁসে গেছে জনতা

, অর্থনীতি

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-23 00:47:20

চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি কোম্পানি জনতা ব্যাংক থেকে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) ও এলটিআর ঋণ (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট বা বিশ্বাসের ঋণ) নিয়ে এখন লাপাত্তা। কোম্পানি সংশ্লিষ্ট কাউকে খুঁজে না পাওয়ায় ব্যাংকের মোটার অংকের টাকাও হাতছাড়া।

ওই কোম্পানির কাছে পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। কোম্পানিটিকে ঋণ দিতে সহযোগিতা করেছেন জনতা ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

চট্টগ্রামের মেসার্স ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল নামের ওই প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালের ১ জুন জনতা ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের এফটিডি/ম্যাক/ঋণপত্র-১৪/এলটিআর-১২/১০ এর মাধ্যমে পুরাতন জাহাজ (এমএস শিট, এমএস রড ও এমএস স্টিল) আমদানি করার জন্য ১০ শতাংশ নগদ ঋণ সীমায় ১৫০ কোটি টাকা এবং ঋণপত্র নিষ্পত্তি সীমা এবং মালপত্র ছাড় করার জন্য ২০ শতাংশ ঋণপত্র সীমায় ১২০ কোটি টাকার এলটিআর ঋণ নেয় শর্ত সাপেক্ষ। কোম্পানিটিকে মোট ২৭০ কোটি টাকার ঋণ দেয় জনতা ব্যাংক।

পরবর্তীতে ২০১১ সালের ১৯ জুলাই স্মারক নং এফটিডি/ম্যাক/এলসি-১৯/এলটিআর-১০/১১ এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী মুঞ্জরির শর্তাবলী অপরিবর্তিত রেখে এক বছরের অর্থাৎ ২০১২ সালের ৩০ মে পর্যন্ত ওই ঋণ সুবিধা নবায়ন করে জনতা ব্যাংক।

মঞ্জুরিপত্রে এলটিআর লিমিটের শর্ত ৭ অনুযায়ী প্রতিটি এলটিআর সৃষ্টির তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে দায় পরিশোধ করতে এবং শর্তাবলীর ৮(খ) অনুযায়ী ৬ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৪টি অনাদায়ী এলটিআর ঋণের টাকা সমন্বয় করার মতো কোনো জামানত নেওয়া হয়নি। ফলে মুঞ্জরিপত্রের ৮ (গ) শর্ত মোতাবেক প্রতিটি এলটিআরের টাকা ৯০ দিনের মধ্যে সমন্বয় করার নির্দেশনা থাকলেও ওই সময়ে বা পরেও তা আদায় করতে পারেনি জনতা ব্যাংক। এতে এলটিআর ঋণগ্রহীতা বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে অডিট অধিদপ্তরের কাছে।

৪টি এলটিআর ঋণের ৯৮ কোটি ৭২ লাখ ৭৮ হাজার ৪৯৩ টাকা ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে অনাদায়ী রয়েছে। মেসার্স ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল এলসির বিপরীতে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধের জন্য মুঞ্জুরকৃত ৪টি এলটিআর ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণ অনাদায়ী এবং আর্থিক ক্ষতি ৯৮ কোটি ৭২ লাখ ৭৮ হাজার ৪৯৩ টাকাসহ এখন পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৬২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

অডিট অধিদপ্তরের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে— বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সহায়ক জামানতের শর্ত মুঞ্জুরিপত্রে অন্তর্ভুক্ত না করায় ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এত ব্যাংকের পাওনা আদায়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি অডিট আপত্তি উত্থাপন করা হয় এবং ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট আধা সরকারি পত্র জারি করা হয়। অডিট উত্থাপন করেন চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের অডিট অ্যান্ড একাউন্টস অফিসার সুজিত কুমার চৌধুরী।

আপত্তিতে জড়িত মেসার্স ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের নামে ৪টি মেয়াদোত্তীর্ণ এলটিআর ৯৮ কোটি ৭২ লাখ ৭৮ হাজার ৪৯৩ টাকা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে ২০১৩ সালের ১ জুলাই মামলা করা হয়েছে। মামলা নং-১৬৮/১৩। পাশাপাশি চেক ডিজঅনারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সিআর মামলা ১৪৯২/১৩ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

আর এই অনিয়মের সঙ্গে জনতা ব্যাংকের সাবেক ডিজিএম মোবারকুল ইসলাম, সাবেক ডিজিএম মো. দিদারুল আলম চৌধুরী, সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার বিভুল কুমার চৌধুরী জড়িত বলে জানা গেছে। এ কারণে তাদের পেনশন বেনিফিট গ্রাহকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। রোববার (০৮ ডিসেম্বর) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উত্থাপিত কার্যপত্র পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া যায়।

মেসার্স ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল দীর্ঘদিন ধরে ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে গম আমদানির ব্যবসায় জড়িত থাকলেও ২০০৭ সালে নাম লেখায় জাহাজ ভাঙা শিল্পে। আর মেসার্স ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ জয়নাল আবেদিন। আর এফঅ্যান্ডএফ শিপ রিসাইক্লিংয়ের নামে ঋণ সুবিদা নিতেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী জয়নালের ভাই মো. আলাউদ্দিন। দুই ভাই মিলে এই টাকা তছরুপ করেছেন। বর্তমানে তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। দেশের বাইরে থাকায় তাদের কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না বলে সংসদীয় কমিটিকে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অডিট অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. রুস্তম আলী ফরাজী বার্তা২৪.কমকে বলেন, এলটিআর সিস্টেমটাই ফ্রড। যখন করা হয়েছিল তখন হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু এখন ব্যবসায়ী আর কর্মকর্তাদের ওপর আস্থা রাখা যায় না। জনৈক ব্যক্তি নাকি আত্মগোপনে তাই তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বলেছি মামলা করতে, তাদের পরিবারের সদস্যদের ধরলে তাকে পাওয়া যাবে। আর ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের ডেপুটি গভর্নরও ক্ষুব্ধ, আমিও ক্ষুব্ধ। আমরা দুটি কমিটি করে দিয়েছি, আগামী দুই মাসের মধ্যে রিপোর্টটা দিতে বলা হয়েছে। আর এলটিআর সিস্টেম বদলাতে বলেছি।

এদিকে কমিটির সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান বৈঠকে বলেছেন, ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের মালিককে আমি চিনি, তিনি কখনো দেশে কখনো আত্মগোপনে। বিষয়টি দুদকের হাতে ছেড়ে দিলে ভালো হবে বলে মত দেন তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর