‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি ইনটেক লিমিটেড। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ছিল ৫৬ দশমিক ২০ টাকা। ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি সেই কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ৪৩ দশমিক ২০ টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকায়। অর্থাৎ এ কোম্পানির ৩ কোটি ১৩ লাখ ২১ হাজার ২২৬টি শেয়ারধারী বিনিয়োগকারীদের ১৩৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ৯৬৩ টাকা উধাও হয়ে গেছে।
ভালো শেয়ার বলে খ্যাত (‘এ’ ক্যাটাগরি) ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানির শেয়ারের দাম ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ছিল ৩ হাজার ৫৪১ দশমিক ৭০ টাকা। ১ বছর ১৫ দিনের ব্যবধানে কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৮৮৯ টাকায়। অর্থাৎ এ কোম্পানির ১৮ কোটি শেয়ারধারী বিনিয়োগকারীদের ২ হাজার ৬৫২ দশমিক ৭০ টাকা করে কমে পুঁজিবাজার থেকে উধাও হয়েছে ৪৭ হাজার ৭৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
ঠিক এভাবে স্টাইলক্রাফট, লিগেসি ফুটওয়্যার, আলহাজ টেক্সটাইল মিলস, ফ্যামেলিটেক্স, জাহিনটেক্স, গ্রামীণফোন এবং স্কয়ার ফার্মাসহ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১২ কোম্পানির মোট ২৫ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৪ বিনিয়োগকারীদের ৭৩ হাজার ৮৯৭ কোটি ৫৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা উধাও হয়েছে।
দিন যতই যাচ্ছে ততই সূচক ও শেয়ারের দাম কমছে। আর তাতে সঞ্চয়, পেনশন এবং ঋণসহ কষ্টে উপার্জিত বিনিয়োকারীদের পুঁজি ততই কমছে। ফলে দিশে হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজি হারানোর প্রতিবাদে মতিঝিলের রাস্তায়ও নেমেছেন কেউ কেউ। যা ২০১০ সালের ধসকেও হার মানিয়েছে। ক্ষিপ্ত হয়ে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানসহ কমিশনের পদত্যাগ এবং কমিশন পুনর্গঠন করার দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করা হয়।
আর বছরব্যাপী দরপতনে আতঙ্কিত হয়ে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়ে দিয়েছেন। বেশিভাগ ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয় রয়েছে। যারা রয়েছেন, তারাও শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে ক্রেতা সংকটে দরপতন অব্যাহত রয়েছে। আর তাতে লেনদেন কম হচ্ছে। লেনদেন কম হওয়ায় ব্রোকারেজ হাউজগুলো লোকসান কমাতে হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেছে।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা এনামুল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমার শ্যালকের পরামর্শে ৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম গত জানুয়ারিতে। এখন সে শেয়ারের দাম ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ চার লাখ টাকার পুঁজি উধাও। এ টাকা আমার মেয়ের বিয়ের খরচের জন্য রেখেছিলাম। এখন আমি কি করব? কীভাবে এ টাকা ফিরে পেতে পারি?
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। তারা এত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন যে আর কোনো ভরসা পাচ্ছেন না। সর্বশেষ ডিএসইর এমডি নিয়োগ নিয়ে বোর্ড সভায় যে ঘটনা ঘটছে, তাও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এটা অশনিসংকেত। কেন যেন বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিএসই প্রতিযোগিতা করে দুঃশাসন নিয়ে আসছে বিনিয়োগকারীদের জন্য।
সার্বিক বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, উত্থান-পতন পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু এখন পুঁজিবাজারে যা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একটি গ্রুপ ‘অগানাইজড ওয়েতে’ বাজার চালাচ্ছে।
এ চক্রের কারণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার লিমিট ২৫ শতাংশ থাকলেও ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করছে না। ব্যাংকগুলো ইচ্ছা করলেই অন্তত ১০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারবে। তার কারণ পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে ১২-১৪ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে ২৫-৩০ শতাংশ লেনদেনে অবদান রাখে। কিন্তু এখন ইতিবাচক কোনো অবদান রাখছে না, যোগ করেন তিনি।
খায়রুল হোসেন আরো বলেন, সবাই বলছে বাজারে এ মুহূর্তে নতুন ফান্ড প্রয়োজন। ক্রান্তিকালে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য আইসিবিকে ১৩ হাজার কোটি টাকার ফান্ড দেওয়া হয়। কিন্তু আইসিবি সেগুলো বিনিয়োগ করছে অন্য খাতে। আর তা দেখে বিদেশিরা বাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। বাজারের ইন্টারমেডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে না। তাই বাজার ভালো হচ্ছে।
এদিকে পুঁজিবাজারের দরপতন ঠেকাতে আবার আশ্বাস দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বরাবরের মতই এবার দরপতন থামাতে সরকারি চার ব্যাংককে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সব তফসিলি ব্যাংককে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে আহ্বান জানান জানানো হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রস্তাবগুলো দেখে পুঁজিবাজারের জন্য সর্বোত্তম সহযোগিতা করা হবে। তবে কি করা হবে তার কোনো সমাধান দেওয়া হয়নি।