শত কোটির জাহাজ ইয়ার্ডে ভিড়লো মাস্টারের বুদ্ধিতে!

ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 01:31:53

জাহাজটি ইয়ার্ডে তোলার সময় ছিল ২টা ৪০ মিনিট। তখন বঙ্গোপসাগরে ভরা জোয়ার। ইয়ার্ড থেকে তখনো খানিকটা দূরে, সোজা জাহাজটি হঠাৎ বাঁকাও হয়ে গেছে। ইয়ার্ডের তিনতলা লবিতে বসে এ দৃশ্য দেখছিলেন ইয়ার্ড মালিক, আমন্ত্রিত অতিথি, সাংবাদিক ও ইয়ার্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে প্রায় ৩০০ লোক।

ইয়ার্ড মালিকরা ছাড়া অন্যরা বুঝতে পারছিলেন না কেন এমন হচ্ছে। তাছাড়া বিচিং অর্থাৎ জাহাজ সাগর থেকে ইয়ার্ডের সীমানায় তুলতে যে গতি থাকা দরকার (১২ নটিক্যাল মাইল) তাও নেই। মালিকদের সবাই উৎকণ্ঠায়। উত্তেজনাও দেখা গেল তাদের মধ্যে।

এর কিছুক্ষণ পরই দেশের নামকরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলির মালিকাধীন ইয়ার্ডে ২৯ বছর আগের জাপানে তৈরি ব্রাজিলের মালিকের ‘ওর ভিটোরিয়া’ জাহাজটি সফলভাবে ইয়ার্ডের সীমানায় উঠে গেল, যা ১০০ কোটি টাকায় কেনা হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে।

১০ মাস আগে দেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব অর্থাৎ গ্রিন শিপ ইয়ার্ডের আন্তর্জাতিক সনদ পায় এ ইয়ার্ডটি। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ২৭ হাজার মেট্রিক টনের বিশাল এ জাহাজটিও গ্রিন শিপ হিসেবে পরিচিত। গ্রিন ইয়ার্ড ছাড়া এ ধরনের জাহাজ বিক্রি করে না জাহাজ মালিকরা। সাধারণ শিপ ইয়ার্ড থেকে তুলনামূলক কম দাম পড়ে এ ধরনের জাহাজের। এতে বিক্রেতা জাহাজ মালিকের মর্যাদা ও সুনাম বৃদ্ধি পায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

ইয়ার্ডের সীমানায় জাহাজ ভেড়ার পর বেশ খুশি হয়েছেন পিএইচপির পরিচালকরা। ৯ পরিচালকের ৬ পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন, মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, ইকবাল হোসেন চৌধুরী, আলী হোসেন সোহাগ, আমির হোসেন সোহেল ও জহিরুল ইসলাম রিংকু উপস্থিত ছিলেন আজ দুপুরে।

প্রতিক্রিয়ায় জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, ‘এতোটা কাছে যে জাহাজটি ভিড়বে, সেটি আমরা কল্পনাও করিনি। অনেক ভালো বিচিং হয়েছে। সাধারণত: বিশাল আকৃতির একটি জাহাজ ইয়ার্ডের নির্দিষ্ট সীমানায় তোলা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। ওর ভিটোরিয়ার বিচিং আমাদের প্রতাশ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।’

তিনতলা ভবনের জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে জাহাজ বিচিং দেখতে গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন, বাংলাদেশ শিপব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি শওকত আলী চৌধুরী, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের ডিআইজি আবদুর হাই, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মকবুল হোসেনসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ৩৬ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত দেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরী।

বিচিং হওয়ার আগে জাহাজটি যখন বেঁকে যাচ্ছিল তিনি বলছিলেন, ‘কোনো সমস্যা হচ্ছে। আমার অভিজ্ঞতায় বলে এরকম হওয়ার কথা না। বিচিং এর সময় জাহাজের গতি থাকে ১২ নর্টিক্যাল মাইল। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে- ৬ নর্টিক্যালও নেই জাহাজের গতি।’

কেন এমন হলো- কেউ এর ব্যাখ্যা দিতে পারছিলেন না। বিচিং শেষে জাহাজ থেকে ইয়ার্ডে নেমে এলেন বিচিং মাস্টার ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাহাজ যে গতিতে চলার কথা সেভাবে এগুনো যাচ্ছিল না। নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। পূর্ণ মাত্রার জোয়ারের সময় নির্দিষ্ট সীমানায় জাহাজ বিচিং করতে হবে। তাই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জাহাজে থাকা সমস্ত পানি ফেলে দিয়ে ওজন হালকা করে ভাসিয়ে তুলি। তারপর নির্দিষ্ট সীমানায় জাহাজ ইয়ার্ডের সীমানার পানিতে নোঙর করি।’

জোয়ারের পর ভাটায় জাহাজটি ইয়ার্ডের সীমানায় থাকা অবস্থায় এটি কাটা হবে। ৫ কোটি দামের টাওয়ার ক্রেন,  সাড়ে ৮ কোটি টাকা দামের বার্জ মাউন্টেড ক্রেন, ৫ কোটি টাকা দামের ২টি ট্রলার ক্রেন, ২টি হাইড্রা ক্রেন, ৬ কোটি টাকা দামের ৬টি ম্যাগনেটিক ক্রেনের মাধ্যমে ২৫০ জন লোক এ জাহাজটি কাটতে সময় লাগবে ৩ থেকে ৪ মাস। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী গ্রিন শিপ ইয়ার্ডের স্বীকৃতি পাওয়ার আগে এ ইয়ার্ডে কাজ করতো প্রায় আড়াই হাজার লোক। তখন এতো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও ছিল না। পিএইচপির ইয়ার্ড ছাড়া পৃথিবীর কোনো ইয়ার্ডেই সুউচ্চ টাওয়ার ক্রেন নেই বলে জানালেন এক কর্মকর্তা।

জাহাজ কেটে লোহার স্ক্র্যাপ, ফার্নিচার, জেনারেটর, পাইপ, ইলেকট্রিক্যাল ক্যাবল, তৈষজপত্র, ফ্রিজ ও এসিসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী বিক্রি করা হয়। লোহার স্ক্র্যাপ থেকে বানানো হয় রডসহ বিভিন্ন লৌহজাত সামগ্রী। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর