পাটের মৌসুমে গ্রামে-গঞ্জে সিন্ডিকেটের হানায় উদ্বিগ কৃষক

ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 10:32:29

জালালপুর (কিশোরগঞ্জ): চারদিক মৌ মৌ করছে পাট ছড়ানোর 'বিশেষ গন্ধ'। বাড়ির আঙিনায়, খেত-খামারের ধারে সারি সারি পাটকাঠি। কোথাও কাচা পাট শুকোতে দেওয়া হয়েছে।

আদিঅন্তহীন ফসলের মাঠ জুড়ে বাতাসে দোলা দিচ্ছে কচি ধানের সবুজ চারা। নিভৃত গ্রাম-বাংলায় জাগছে শরতের অনিন্দ্য শোভা।

'মাঠে মাঠে এখন অগ্রহায়ণ ধান বপন করা হয়েছে। হাল্কা বৃষ্টি আর রোদে তরতর করে বড় হবে চারা। হেমন্তে ঘরে তোলা যাবে ধান।' মাঠ দেখাতে দেখাতে বললেন আবদুল কুদ্দুস।

ধানের পাশাপাশি পাটের দিকেও সমান মনোযোগ এই মাঝ বয়েসী কৃষকের, 'এখন পাট তোলার মৌসুম। দামও শুরুর দিকে ভালো পেয়েছি। ২২ শ টাকা মন।'

কথাগুলো বলেই মন খারাপ করলেন তিনি। খানিক থেমে উদাসী গলায় বললেন, 'দিনে দিনে দাম কমে যাচ্ছে পাটের। ফড়িয়া ও দালালরা সিন্ডিকেট করে কৃষকদের জিম্মি করে ফেলেছে। ১৫/১৬ শ টাকার বেশি দাম দিতে চাচ্ছে না।'

পাটের মৌসুমে গ্রামে-গঞ্জে সিন্ডিকেটের হানায় উদ্বিগ কৃষক আবদুল কুদ্দুসের মতো অনেকেই। ফসল তোলার যে উচ্ছ্বাস গৃহস্থ ঘরে সচরাচর দেখা যায়, তা যেন অনুপস্থিত। কারণ, বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য বিপণন ব্যবস্থার শীর্ষ থেকে শেকড় পর্যন্ত হাঙরের মতো হানা দিয়েছে সিন্ডিকেট। সরকার ও প্রশাসন দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে কিছুদিন পরেই পাট হবে কৃষকের গলার ফাঁস!

কিশোরগঞ্জ শহরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় গ্রামগুলো পাট, ধান আর মাছের জন্য প্রসিদ্ধ। আশেপাশের নীলগঞ্জ, কালিগঞ্জ, লক্ষ্ণীগঞ্জ বাজারে বিরাট বিরাট পাটের গুদাম।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বাজারগুলোর পত্তন করেছিল সাহেবরা। পরে পাকিস্তানি মালিকের হাত হয়ে এসব কারবার স্থানীয় বড় বড় ব্যাপারী-মহাজনদের কব্জায় চলে এসেছে। তারা গ্রামের সব পাট কিনে নারায়ণগঞ্জের মিলে পাঠান বিশাল নৌকা বা ট্রাকে। দামও নিয়ন্ত্রণ করে এরাই।

আশেপাশের ৫০ মাইলের মধ্যে কয়েকটি নীলকুঠির ভগ্নাবশেষও রয়েছে। আর আছে কৃষক বিদ্রোহের স্মৃতিবিজড়িত বহু জায়গা।

'কিশোরগঞ্জের উত্তরাঞ্চলের রশিদাবাদ, লতিবাবাদ, মহিনন্দ, মাইজকাপন ইউনিয়নগুলো ব্রিটিশ আমল থেকেই ঐক্যবদ্ধ। কৃষক-খেতমজুর শ্রেণি সুসংবদ্ধ ও সংগ্রামমুখর ইতিহাসের অধিকারী', জানান জেলা আওয়ামী লীগের নেতা শাহ আজিজুল হক।

'আগের সেই আন্দোলনময় পরিস্থিতি এখন না থাকলেও আমরা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য আদায়ের জন্য চেষ্টা করছি। দালাল ও ফড়িয়াদের কারণে অনেক সময়ই কৃষক ধান, পাটের উৎপাদন মূল্যও পায় না। সরকারি ক্রয়কেন্দ্র খুলে কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি,' বলেন গণতন্ত্রী পার্টির নেতা ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন।

ঘরে ঘরে পাটের স্তূপ আর মাঠে মাঠে ফসলের হাতছানির আশাবাদী পরিস্থিতিতে পাট ব্যবসায়ী, দালাল, ফড়িয়া, মহাজনেরা গুটি গুটি পায়ে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম-বাংলায়। অসাধু সিন্ডিকেট বানিয়ে পাটের ন্যায্যদাম ও বাজারদর কমিয়ে ফেলেছে। দিনে দিনে বিপাকে ফেলছে পাট উৎপাদনকারী কৃষকদের।

গ্রাম-গঞ্জের সরেজমিন পরিস্থিতির আলোকে মুনাফালোভী-অসাধু চক্রের যে ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন দেখা যাচ্ছে, তা কঠিন হাতে দমন করতে হবে। সিন্ডিকেটের কবল থেকে কৃষি ও কৃষকদের বাঁচানোর জন্য নিতে হবে তড়িৎ ব্যবস্থা। সম্ভাবনাময় রূপালি আঁশ পাটকে কৃষকের গলার ফাঁস বানানোর অপচেষ্টা বানচাল করতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর