রংপুর-১ আসন: জাপায় রাঙ্গা, আ.লীগে একাধিক প্রার্থী

বিবিধ, নির্বাচন

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 10:47:25

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরই মধ্যে নির্বাচনী ট্রেনের টিকেট পেতে রাজনৈতিক পল্লীতে শুরু হয়েছে দৌড়ঝাঁপ। কেউ কেউ আবার দলের আগাম সবুজ সংকেত পেয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন।

তেমনই একজন রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও রংপুর সিটি করপোরেশনের আংশিক) আসনের বর্তমান এমপি মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি একাধারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির (জাপা) সভাপতি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়েছেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। তার এই জয়ের মধ্য দিয়ে এক সময়ের অবহেলিত গঙ্গাচড়া প্রথমবারের মতো একজন প্রতিমন্ত্রী পেয়ে যান। এরপর থেকে বদলে যেতে থাকে তিস্তা নদী বিধৌত গঙ্গাচড়া।

এক সময়ের মঙ্গা কবলিত গঙ্গাচড়া এখন আগের অবস্থায় নেই। মসিউর রহমান রাঙ্গা তার জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় উন্নয়নের চাদর বিছিয়েছেন এখানে। প্রতিমন্ত্রী হয়েও ফ্রি সময় পেলেই ছুটে আসেন নির্বাচনী এলাকাতে। খোঁজখবর রাখেন সাধারণ মানুষের। কখনো কখনো মেঠোপথ ধরে হেঁটে হেঁটে যান কৃষকের কাছে। নতুবা তিস্তাপাড়ে বসে স্বপ্ন দেখেন রাক্ষুসে নদীর শোষণ দমনের।

গঙ্গাচড়ার নাড়ির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করায় মসিউর রহমান রাঙ্গা এখন আমজনতার রাঙ্গা হিসেবে পরিচিত। তার হাত ধরে এই আসনে ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। এ কারণে এখানকার অনেকেই বিশ্বাস করেন ‘রাঙ্গা মানে চাঙা’।

তবে এই ‘রাঙ্গাতে গঙ্গাচড়া চাঙা’ এটি মানতে নারাজ স্থানীয় আওয়ামী লীগ। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সরকার প্রধান শেখ হাসিনার সুনজরেই অবহেলিত গঙ্গাচড়া থেকে মঙ্গা দূর হয়েছে। উন্নয়ন ছড়িয়ে পড়েছে পল্লীর পরতে পরতে। তাই শেখ হাসিনার অবদানের মূল্যায়ন ও কৃতজ্ঞতা জানাতে ব্যালট পেপারে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে জয়ী করতে কোমর বেঁধেছেন তারা।

গত সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের ব্যানারে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পার পেয়ে গেলেও এবার সেই সুযোগের সম্ভাবনা নেই এই আসনে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা উঠে পড়ে নেমেছেন। বহিরাগত ঠেকাও স্লোগানে নিজেদের পক্ষে জোয়ার তুলতে গিয়ে একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রচারণায় মুখরিত আওয়ামী লীগে তৈরি হয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল।

জনসাধারণও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে রয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। সেইদিক থেকে জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী হিসেবে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন রাঙ্গা।

এখানে বর্তমানে কোন্দলমুক্ত দল হিসেবে ভোটারদের মন জয়ে এগিয়ে আছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দাবি মহাজোট হোক আর নাই হোক, ব্যালট যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ের মালা গলায় পড়তে জটিল অংক কষতে হবে না প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গাকে।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সালের ভোট যুদ্ধে এই আসনটি বরাবরই জাতীয় পার্টির দখলে রয়েছে। জাতীয় সংসদের ১৯নং আসনটিতে (রংপুর-১ আসন) ১৯৯১ সালে এরশাদের লাঙ্গল কাঁধে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন করিম উদ্দিন ভরসা, ১৯৯৬ সালে সরফুদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টু, ২০০১ সালে মসিউর রহমান রাঙ্গা, ২০০৮ সালে এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মসিউর রহমান রাঙ্গা। দ্বিতীয়বারের মতো এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী পরিষদে জায়গা হয় তার।

তবে রাঙ্গার জয় ঠেকাতে নির্বাচনী মাঠে আলোচনায় আছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সুসম্পর্ক ও দারুণ সখ্যতার কারণে তিস্তা নদী শাসনের জন্য প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গা ১২৯ কোটি টাকার বরাদ্দ আনতে পেরেছেন। গেল পাঁচ বছরে গঙ্গাচড়াতে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মাদরাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও সংস্কারে ব্যাপক অনুদান এনেছেন তিনি। বদলে দিয়েছেন এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। নতুন নতুন রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ, ছোট ছোট সেতু নির্মাণ করেছেন। মাইলের পর মাইল কাঁচা রাস্তাকে পিচঢালা রাস্তা বানিয়ে মূল সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। তার মাধ্যমে অভূতপূর্ব উন্নয়নের সমন্বয় ঘটেছে এই উপজেলাতে।

শীতার্ত ও বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ন্যাশনাল সার্ভিস চালু, বিধবাভাতা, বয়স্কভাতা, হতদরিদ্রদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। জনবান্ধব এমপি হিসেবে তার জনপ্রিয়তা এখানে ঈর্ষণীয়। তাই মহাজোটের ব্যানারে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে এলে এই আসনে রাঙ্গার বিকল্প কাউকে না দেখার সম্ভাবনাই বেশি। আর যদি একক নির্বাচন হয় বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নৌকা-লাঙ্গলের প্রার্থীর মধ্যে।

বর্তমানে গঙ্গাচড়াতে যে নির্বাচনী হাওয়া বইছে তাতে আওয়ামী লীগের তিন থেকে চারজন সম্ভাব্য প্রার্থী নিজেদেরকে নৌকার মাঝি হিসেবে জানান দিয়ে শুরু করেছেন প্রচারণা। এতে করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে গ্রুপিং। যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ ভোটারদের ভেতরেও।

স্থানীয় ভোটারদের দেয়া তথ্য মতে, এ আসনটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে ভোটে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো জামায়াতে ইসলামীর। আওয়ামী লীগ সব সময় তৃতীয় অবস্থানে থাকত। তবে নিবন্ধন বাতিল হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এখানে এখন আর আগের মতো অবস্থান নেই জামায়াতের।

বর্তমানে উন্নয়নের স্রোতে দেশকে এগিয়ে নেয়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন জোরেশোরে। এতে করে জাতীয় পার্টির সঙ্গে লড়াই করার মতো অবস্থান এখানে সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন নৌকার সমর্থকরা।

অন্যদিকে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ওয়াহেদুজ্জামান মাবু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোকাররম হোসেন সুজনের নাম শোনা গেলেও তেমন কোনো প্রচারণা নেই গঙ্গাচড়াতে। তবে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ভেতরের প্রস্তুতি ঠিক রয়েছে বলে জানা গেছে।

গঙ্গাচড়া উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শামসুল আলম জানান, গঙ্গাচড়ায় জাতীয় পার্টি ৯০ দশকের মতো আবারো ফিরে এসেছে। জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলেও এই আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। আর জোট হলে তো বিজয় ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।

জানা গেছে, নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে প্রচারণার মাঠে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য রবিউল ইসলাম রেজভী, উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমীন, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম রাজু এবং আওয়ামী লীগের আরেক সমর্থন প্রত্যাশী শিল্পপতি সিএম সাদিককে ঘিরে দ্বিধাদ্বন্দ্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীরা।

মহাজোট থেকে জাপা বেরিয়ে এলে এখানে আওয়ামী লীগের নৌকায় বৈঠা হাতে পাবার সম্ভাবনা বেশি বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলুর। আর যদি হিসেব উল্টাপাল্টা হয় তাহলে মনোনয়ন দৌড়ে অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম রাজুর ভাগ্যে যেতে পারে নৌকার টিকিট।

নির্বাচনের ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু বলেন, ‘দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। এখানে স্থানীয় লোকের এমপি হবার সুযোগ হয়নি। বহিরাগত দ্বারা গঙ্গাচড়ার মানুষ যুগের পর যুগ শাসিত হয়ে আসছে। এবার জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। স্থানীয় প্রার্থীকেই জয়ী করবেন। সেই হিসেবে নৌকার মাঝির গলাতে বিজয়ের মালা উঠবে বলেও আমার বিশ্বাস।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর