অঘটনের জন্ম দিতে চায় আ.লীগ, প্রস্তুত এরশাদ

বিবিধ, নির্বাচন

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 17:25:29

লাঙ্গল মার্কা হলেই জাতীয় পার্টির (জাপা) দুর্বল প্রার্থীও নির্বাচনে জয়ী হতেন। নির্বাচনী প্রচারণারও খুব একটা প্রয়োজন হতো না। কিন্তু এখন চিত্র একেবারেই উল্টো। আগের মতো নেই রংপুর অঞ্চলের ভোটারদের সস্তা আবেগ। রাজনীতিতে এরশাদের ডিগবাজি নাটকে ভারাক্রান্ত এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। এতে করে দুর্গ খ্যাত রংপুরে এখন কঠিন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে দলটিকে। অথচ এক সময় এরশাদ মানেই রংপুরকে বোঝানো হতো।

অতীত নির্বাচনের ইতিহাস বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনে ভোটের লড়াইয়ে জাতীয় পার্টি বরাবরই এগিয়ে ছিল। ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টি ১৭টি, আওয়ামী লীগ ৯টি এবং বিএনপির দখলে ছিল একটি আসন। অন্যান্য দল জয় পেয়েছিল ছয়টি আসনে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি ২১টি, আওয়ামী লীগ ৮টি, বিএনপি ৩টি আসন পায়। আর অন্যান্য দল পায় একটি আসন। ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের আসন কমে, আর বাড়ে বিএনপির। সে সময় বিএনপি ৯টি, আওয়ামী লীগ ৬টি, জাতীয় পার্টি ১৪টি আসন পায় এবং অন্যান্য দল ৪টি আসন পেয়েছিল।

তবে রাজনীতিতে জোট মহাজোটের নতুন মেরুকরণে ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির দখলে ভাগ বসাতে থাকে আওয়ামী লীগ। এতে করে হোঁচট খেয়ে বসে এরশাদের জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৯টি, জাতীয় পার্টি ১৩টি এবং অন্যান্য দল একটি আসন পায়। আর সর্বশেষ বিএনপিহীন ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এরশাদের দুর্গের ভিত তছনছ করে এই বিভাগের ৩৩টি আসনের মধ্যে ২২টি আসনে জয় ছিনিয়ে নেন আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি পায় মাত্র সাতটি। আর অন্যান্য দল পায় ৪টি আসন।

একের পর এক নির্বাচনে জাতীয় পার্টির শোচনীয় পরাজয় আর নিজ দুর্গ হাতছাড়া হওয়ায় বর্তমানে রংপুর সিটির মধ্য থেকে ২৫টি ওয়ার্ড ও সদর এলাকা নিয়ে গঠিত রংপুর-৩ আসনে সেই আগের উজ্জ্বলতা নেই।

এখানকার আওয়ামী লীগসহ বাম দলের নেতাদের দাবি, মহাজোটের বাইরে থেকে জাপার চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবার নির্বাচন করলে ঘটতে পারে অঘটন। আর সেই অঘটনের জন্ম ঠেকাতে এই নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে জাতীয় পার্টি। সঙ্গে রংপুর অঞ্চলে হারানো আসনগুলো ফিরে পেতেও চায় তারা।

এদিকে এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেকটা দুর্বল হওয়ায় রংপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। তাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন বার্তা তুলে ধরে নৌকার প্রার্থী হতে গণসংযোগ করে বেড়াচ্ছেন বেশ কয়েকজন মনোনয়ন প্রত্যাশী ব্যক্তি।

স্থানীয় ভোটারদের অভিমত, বিএনপি দুইবার ক্ষমতায় থেকে রংপুরের জন্য কিছুই করেনি। বরং রংপুরের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শিক্ষাবোর্ডকে সরিয়ে দিনাজপুরে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতার নামে টালবাহানা করতে করতে সেটিও নিয়ে গেছেন দিনাজপুরে। এ কারণে বিএনপির প্রতি আস্থা নেই। এই দলের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন রংপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিজু ও সহ-সভাপতি কাওছার জামান বাবলা।

অন্যদিকে নয় বছরের শাসনামলে কোলের ছাওয়াল এরশাদ স্থানীয় জনগণের কাঙ্ক্ষিত দাবি পূরণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে জোটগত রাজনীতির মেরুকরণে ভিন্নতা এনে শেখ হাসিনা ও এইচ এম এরশাদ ক্ষমতার মসনদে বসে এখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবিগুলো পূরণ করেছেন। রংপুরকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলতে সবটাই করেছেন তারা। রংপুর বিভাগ, সিটি করপোরেশন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপনসহ রংপুরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বর্তমান শাসকদলের নেক নজরে। উন্নয়নের ক্যালকুলেশনে জাতীয় পার্টির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এখন আওয়ামী লীগ।

এদিকে জাতীয় পার্টি থেকে এরশাদই রংপুর-৩ আসনে নির্বাচন করবেন। ইতোমধ্যে কাঙালি ভোজ, গণসংযোগ, বেশ কয়েকটি ছোট জনসভা করেছেন তিনি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ থেকে নৌকার মনোনয়ন তদবিরে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড পরিচালক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম, জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নাছিমা জামান ববিসহ বেশ কয়েকজন। সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে পাড়া-মহল্লায় প্রচারণার পাশাপাশি ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন সাঁটিয়েছেন নৌকা প্রতীক প্রত্যাশীরা।

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নাছিমা জামান ববি বলেন, সস্তা আবেগ আর মায়াকান্না দিয়ে এখন ভোট হয় না। মানুষ উন্নয়নে বিশ্বাসী। কাজ দেখতে চায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরবাসীর জন্য অনেক কিছু করেছেন। এ কারণে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। শেখ হাসিনার ঋণ শোধ করতে নৌকা প্রতীকে ব্যালট বিপ্লব হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

সদ্যপুস্করণী ইউনিয়নের কৃষক আবদুল হামিদ মিয়া, মাহিগঞ্জ এলাকার আসমত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা তো বারবার লাঙ্গলে ভোট দিয়েছি। এরশাদকে জেল থেকে মুক্ত করেছি। কিন্তু আমাদের জন্য তিনি তো কিছুই করেননি। কয়েক দফায় এমপি নির্বাচিত হয়েও এলাকার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারেননি। বেশিরভাগ সময় তিনি ঢাকায় থাকেন। তাকে সুখ-দুঃখে কাছে পাওয়া যায় না। এ বিষয়টি প্রবীণ ভোটারদের পাশাপাশি তরুণ ভোটারদেরও ভাবাচ্ছে। তাই আসন্ন নির্বাচনে ভোটাররা নতুন প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করলে অবাক হবার কিছুই থাকবে না।’

এরশাদের বাসার পাশের এলাকা শাপলা চত্বর। সেখানকার ব্যবসায়ী সেকেন্দার আলী জানান, এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একজন সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে এরশাদকে জিততে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। সুযোগ সন্ধানী আচরণ ও কথা-কাজের মধ্যে অমিলের কারণে আগের মতো এরাশাদকে বিশ্বাস করতে পারে না মানুষ।

সাধারণ ভোটারদের এই ভাবনা সঠিক নয় বলে মনে করছেন রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি ও সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তিনি জানান, রংপুরের উন্নয়নে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের যে অবদান রয়েছে, তা আর কোনো এমপির নেই। রংপুরে যা হয়েছে সবই এরশাদের কারণে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে তুলে রংপুরকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলেছেন। এখন তিনি প্রতি মাসে রংপুরে আসেন। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টি এখন পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে সাংগঠনিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই রংপুর-৩ সহ হারানো সব আসনেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীদেরই বিজয়ী হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি রয়েছে।

এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে রংপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, জাতীয় পার্টি ছাড়াও জাসদ, বাসদ, ইসলামী আন্দোলন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্যসহ বিভিন্ন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নিজেদের প্রস্তুত করে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। গত নির্বাচনে এরশাদের সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা জাসদের সাব্বির আহমেদের এবার নির্বাচন করার কথা রয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর