পুলিশের নিরপেক্ষ ভূমিকা কতটুকু সম্ভব? -প্রশ্ন মাহবুব তালুকদারের

বিবিধ, নির্বাচন

ইসমাঈল হোসাইন রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | 2023-07-01 21:33:51

"শিডিউল ঘোষণার পূর্বে যে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, শিডিউল ঘোষণার পর তার পক্ষে রাতারাতি পাল্টে গিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা কতটুকু সম্ভব?"

বৃহস্পতিবার (২২ নভেম্বর) নির্বাচন ভবনে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক বিশেষ সভায় নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এমন প্রশ্ন তুলেছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিশেষ সভায় দেয়া বক্তব্যে কমিশনার মাহবুব তালুকদার গায়েবি মামলাসহ, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহসহ পুলিশের বেশ কিছু কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করেন। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিডিউল ঘোষণার পূর্বে যে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, শিডিউল ঘোষণার পর তার পক্ষে রাতারাতি পাল্টে গিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা কতটুকু সম্ভব? তিনি বলেন, পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।

মাহবুব তালুকদার বর্তমান কমিশনের মেয়াদে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুনামের সাথে করতে পারলেও বাকি পাঁচটির ক্ষেত্রে তা ছিলো না। গাজীপুর ও বরিশাল সিটি নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে তিনি এ দুটি নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তুলে ধরেন ইসির তদন্তে উঠে আসা পুলিশ বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের প্রশ্নবিদ্ধ ভুমিকার কথা।

তিনি উল্লেখ করেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ১৭৯জন প্রিজাইডিং কর্মকর্তার তালিকা দিয়েছিল, যা রিটার্নিং কর্মকর্তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তা জেলা প্রশাসক অফিসের নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার স্বাক্ষরসহ একটি ফরওয়াডিং দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল। ওই নির্বাচনে পুলিশের বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ কর্তৃক বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও এ সংক্রান্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো ১১টি চিঠি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। এর মধ্যে চারটি চিঠির দায়সারা জবাব দেয় পুলিশ। সাদা পোশাকধারী পুলিশের বিষয়ে বলেন, অনেককে গ্রেফতারের পর তা স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু পরে অনেককে কেন্দ্রীয় করাগারে পাওয়া গেছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যদি গ্রেফতার করা না হয় তাহলে কীভাবে কারাগারে পাওয়া গেছে তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

 

বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেন, পাঁচ সিটির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ছিল বরিশাল। সকালে ভোটগ্রহণ ভালো হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে বিভিন্নমুখী অনিয়ম শুরু হয়। বেলা ১১টার মধ্যে প্রতীয়মান হয় এভাবে ভোটগ্রহণ চলতে পারে না। এক পর্যায়ে কমিশন মনে করে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করা প্রয়োজন। পরে কমিশন ভোটগ্রহণ বন্ধ করতে সম্মত হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেয়া, নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে কী না- তা ভেবে নির্বাচন বন্ধ করা থেকে আমরা বিতর থাকি। ওই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে সংসদ নির্বাচন কিভাবে সুন্দর করা যায় সেই পথ বের করার কথাও বলেন তিনি।

গায়েবি মামলা নিয়ে এই কমিশনার বলেন, বর্তমানে বহুল আলোচিত গায়েবি মামলা এখন আর গায়েবি আওয়াজ নয়। হাইকোর্টও বলেছেন এই ধরনের মামলায় পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। ঢাকা পুলিশ কমিশনার গায়েবি মামলা না করতে পুলিশ বাহিনীতে নির্দেশনা দিয়েছেন। তারপরও অনেকক্ষেত্রে এই ধরনের মামলা চালু রয়েছে।

গায়েবি মামলা ইস্যুতে ইসিতে দেয়া বিএনপির আবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু সংখ্যক গায়েবি মামলার আসামিদের তালিকা বিরোধী দল থেকে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। মামলাগুলো পুরনো হলেও এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের অনেকের আদালত থেকে জামিন নেয়া হয়তো সম্ভব হবে না। কোন কোন সম্ভাব্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা থাকার কারণে তারা প্রচারকাজ চালাতে ভয় পাচ্ছেন। এই ভীতি সর্বক্ষেত্রে অমূলক নয়। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে প্রার্থীরা যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তা যথাযথভাবে প্রতিপালন করা প্রয়োজন।

গ্রেফতারের বিষয়ে উচ্চ আদালতের যে নির্দেশনা রয়েছে তা কোথাও প্রতিপালন হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্দেশনাটিতে মানবিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখার যে অভিব্যক্তি রয়েছে, তা প্রতিপালিত হলে পুলিশের আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা অনেকাংশে কমে যেতে পারত। কমিশন আশ্বাস দিলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লেভেল ফিল্ড কার্যকর ছিলো না। নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরিতে পুলিশের বিরাট ভুমিকা রয়েছে। পুলিশ সবার সাথে সমান আচরণ করলে তা সম্ভব হতে পারে।

নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তথ্য যাচাই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহে পুলিশ দুইমাস আগেই মাঠে নেমেছে। তারা প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং কর্মকর্তাদের বিষয়ে নানাধরনের তথ্য সংগ্রহ করছে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এই ধরনের তথ্যানুসন্ধানে পুলিশকে কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। কে কী উদ্দেশ্যে এইসব কর্মকাণ্ড করছে তা রহস্যজনক। অতি উৎসাহি কিছু পুলিশ সদস্যদের এই কর্মকাণ্ড ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, যার দায় কমিশনের ওপর এসে পড়ে।

এবারের সংসদ নির্বাচনকে গুরুত্বপুর্ণ আখ্যায়িত করে এই কমিশনার বলেন, শুধু দেশবাসী নয়, বিশ্ববাসী আমাদের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই নির্বাচন আমাদের আত্মসম্মান সমুন্নত রাখার নির্বাচন। আমরা কোনভাবেই এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দিতে পারি না। আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে তার দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ওপর বর্তাবে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হলে আমরাও তার দায় এড়াতে পারবো না।

আশা করি, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।

এ সম্পর্কিত আরও খবর