দেশের নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্য হাঁকডাক দিয়ে ২৮টি রাজনৈতিক দল চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
নির্বাচনের ফলাফলে বেশির ভাগ দলের প্রার্থী ও দলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এই তালিকায় রয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হেভিওয়েট প্রার্থীরাও।
জাতীয় নির্বাচনের চার মাস পর অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের বড় নির্বাচন উপজেলা পরিষদ। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রতীকে অংশগ্রহণ না করলেও দলের নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্রভাবে ভোটের মাঠে লড়ছেন।
এবারের ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ কয়েকটি দল সরাসরি ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। সংসদ নির্বাচনে বেশ ঘটা করে অংশ নিলেও ভোটপ্রাপ্তিতে তলানিতে থাকার পর পরবর্তীতে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি সাংগঠনিক তৎপরতাহীন হয়ে পড়ে।
উপজেলা নির্বাচন নিয়েও তাদের তোড়জোড় নেই। কোথাও নেই তাদের দলীয় প্রতীকের প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী। ফলে ভোটে যেমন কমেছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তেমনি কমেছে ভোট পড়ার হার। আবার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় দুই দফার নির্বাচনে ৪৯ জন ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী, এবারের উপজেলা নির্বাচন চার ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উপজেলায় পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। তবে কিছু উপজেলায় দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিএনপির তৃণমূলের নেতারা প্রার্থী হয়েছেন। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনে নামসর্বস্ব দল আলোচনায় থাকলেও বেশির ভাগ দলের আলোচনা নেই উপজেলা নির্বাচনে।
এবারের উপজেলা নির্বাচনে নিবন্ধিত কোনো দলই দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেন। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও নামমাত্র অংশ নিয়েছে নির্বাচনে। নির্বাচনের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দলটির ভোটব্যাংকও তলানিতে। সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর আরো কোণঠাসা দলটির অবস্থান।
২০১৫ সালে ‘তৃণমূল বিএনপি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন বিএনপির এক সময়ের নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা।
বিএনপি থেকে দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারকে নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর দলটির প্রথম কাউন্সিল হয়। নিজেদের ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১শ ৩৩টি আসনে প্রার্থী দিলেও কোনোটিতেই জয় পায়নি তৃণমূল বিএনপি। দলটির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হয় তখন। জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবির পর চলতি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়নি দল ও দলের কোনো নেতাকর্মী।
উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি অংশ নেয়নি কেন জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মেজর (অব.) ডা. শেখ হাবিবুর রহমান বার্তা২৪কমকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনে বহিরাগত ও অযোগ্য লোক দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব হয়ে টাকা-পয়সা লুট করে দলের ক্ষতি করছেন। নির্বাচনে দলের লোকজনকে নামিয়ে কোনো সহযোগিতা করেনিন। ফলে দলের নেতাকর্মীরা দলের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন। সাংগঠিকভাবে অগোছালো থাকায় তৃণমূল বিএনপি এইবারের উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে এই নেতা বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে দল গুছিয়ে আগামীতে নির্বাচনে যাবে দলটি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল আজিজ সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনে আমাদের কোনো প্রার্থী আশানুরূপ ফলাফল করতে পারেননি। দলের ভেতরে নেতাকর্মীরা হতাশা রয়েছেন। দলীয় ও নেতাকর্মীদের অবস্থা বিবেচনা করে আমরা এবারের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি। সামনে দলকে শক্তিশালী করে স্থানীয় সরকারের অন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি।
এদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর অনাগ্রহে উপজেলা নির্বাচনে কমেছে ভোটের হার। সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি বেশি থাকে। কিন্তু ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেখা যায়, প্রথম দুই ধাপের নির্বাচনে ভোটের হার গড়ে ৩৫ শতাংশ।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় সংসদের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের হার কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। দিনে দিনে যেভাবে ভোটের হার কমছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচন ও নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। একপক্ষীয় ব্যবস্থায় দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা চলে যাওয়ায় ভোটে আস্থা হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে, তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির মতো দল সংসদ নির্বাচনে আলোচনায় থাকায় ইসলামী ঐক্যজোট ও জাকের পার্টি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
ইসলামী ঐক্যজোটের প্রচার সম্পাদক আনছারুল হক ইমরান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি না। বিক্ষিপ্তভাবে দুই, একজন হয়ত স্বতন্ত্র পরিচয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বলে তৃণমূল থেকে জানা গেছে।
জাকের পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের দল এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি। একইসঙ্গে প্রথম দুই দফায় কোনো প্রার্থী দেয়নি। পরবর্তী দুইধাপে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে দেওয়া হয়নি।
এদিকে, মহাজোটে থাকা সরকারপন্থী দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি, জেপি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি বিক্ষিপ্তভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। দলগুলো যেখানে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ও ভোটব্যাংক রয়েছে, এমন জায়গা দেখে প্রার্থী দিয়েছে দলগুলো।
এর আগে ২০১৯ সালেও বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো স্থানীয় সরকারের নির্বাচন বর্জন করে। সেই সময় সরকার সমর্থিত একাধিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তারও আগে ২০১৪ সালে বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল স্থানীয় সরকারের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সেই নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল; তেমনি নির্বাচনে ভোটের হার ছিলও উল্লেখযোগ্য।
২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৬০ শতাংশের ওপরে। এবারের নির্বাচনে ভোটের হার ৩৫ শতাংশ।