সিটি নির্বাচনে এগিয়েছে কেবল ইসলামী আন্দোলন!

, নির্বাচন

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম | 2023-09-01 10:01:35

সদ্যসমাপ্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পর জায়গা করে নিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীদের ভোটের ফলাফল চমক তৈরি করেছে রাজনৈতিক বোদ্ধামহলে। যদিও নির্বাচনের দিন (১ ফেব্রুয়ারি) ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে ভোট প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি দলটির নেতারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনে খরচ করা টাকা ফেরত চেয়ে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন।

ভোটের নানা হিসাব করে দেখা গেছে, প্রায় সবদলের প্রাপ্ত ভোট কমেছে। কিন্তু ব্যতিক্রম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, তাদের ভোট বেড়েছে। দলগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে তারা। দলটি দুই সিটিতেই প্রার্থী দিয়ে নিজেদের ঘরে তুলে নিয়েছে ৫৪ হাজার ৭২৫ ভোট। অর্থাৎ ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ ভোট পড়েছে হাতপাখা প্রতীকে। দলটির উত্তরের প্রার্থী অধ্যক্ষ শেখ মো. ফজলে বারী মাসউদ পেয়েছেন ২৮ হাজার ২০০ ভোট এবং দক্ষিণের প্রার্থী আলহাজ্ব মো. আবদুর রহমান পেয়েছেন ২৬ হাজার ৫২৫ ভোট।

এর আগে ২০১৫ সালের নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটিতে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী অধ্যক্ষ শেখ ফজলে বারী মাসউদ কমলালেবু প্রতীকে ১৮ হাজার ৫০ ভোট পান। আর ঢাকা দক্ষিণে আলহাজ্ব আবদুর রহমান ফ্লাস্ক প্রতীকে ১৫ হাজার ৪৭৯ ভোট পেয়েছিলেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ছবি: বার্তা২৪.কম 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন মনোনীত একজন কাউন্সিলর প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। ৬৭ নং ওয়ার্ড হাজী মো. ইব্রাহিম খলীল লাটিম প্রতীকে ৪ হাজার ৫৫৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন, আর বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে নির্বাচন শেষ করেছেন। দলটি ঢাকা দক্ষিণে ২০ জন ও উত্তরে ১৮ জন কাউন্সিলর মনোনয়ন এবং আরও ১০-১২ জন প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিলো।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দল। নিবন্ধন নম্বর ৩৪। দলীয় প্রতীক হাতপাখা। ১৯৮৭ সালে চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এর আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম পীর সাহেব চরমোনাই।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ আসনের মধ্যে ২৯৭টিতেই প্রার্থী দিয়েছিল দলটি। হাতপাখা প্রতীক নিয়ে সর্বাধিক আসনে ভোটযুদ্ধে নেমে দলটির মনোনীত প্রার্থীরা পেয়েছেন ১২ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ ভোট। তবে একজন বাদে বাকি সবাই জামানত হারান। দলটি ভোট পেয়েছিল মোট ভোটের ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ভোটের হিসাবে দলটির অবস্থান চতুর্থ হলেও প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান সবার উপরে।

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাদে অন্যকোনো ইসলামি দল প্রার্থী দেয়নি। দুই সিটি নির্বাচনে দলটির আমির পীর সাহেব চরমোনাই থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। প্রার্থীদের মিডিয়া সমন্বয় ছিলো উল্লেখ করার মতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রার্থীর সমর্থকদের সরব উপস্থিতিও ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলেছে। নির্বাচনী মাঠের প্রচারের পাশাপাশি গণমাধ্যমও তাদের ভালো কাভারেজ দিয়েছে। এসব মিলিয়ে দলটি নির্বাচনে ভালো ফলাফল করেছে।

তবে দলটির যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ভোট সুষ্ঠু হলে আমাদের প্রার্থীরা আরও ভালো করতো। স্বাধীনতার পর থেকে যেসব দল দেশ শাসন করেছে, তাদের ওপর মানুষের আস্থা নেই। তাই তো দিন দিন মানুষের আস্থার প্রতীকে পরিণত হচ্ছে হাতপাখা।

প্রচারণায় চরমোনাইয়ের পীর, ছবি: বার্তা২৪.কম

ভোটের দিনের পরিবেশের কথা উল্লেখ করে এই রাজনীতিবিদ বলেন, আমাদের লোকজন বিশেষ করে মুরব্বি ও নারীরা মান-ইজ্জত হারানোর ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে আমাদের প্রাপ্ত ভোট আরও বাড়তো।

ধর্মীয় নানা ইস্যুসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলন রাজপথে সরব। দলটির ভ্রাতৃপ্রতীম ছাত্র ও যুব সংগঠন, মোজাহিদ কমিটি এবং সহযোগী সংগঠনগুলোও বেশ সংগঠিত। সবমিলিয়ে বলা চলে, তারা বেশ সুকৌশলে এগোচ্ছে। এরই প্রভাব পড়েছে সিটি নির্বাচনে।

ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুই সিটিতেই মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ছাড়া অন্য প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, প্রদত্ত ভোটের ৮ ভাগের এক ভাগ ভোট না পেলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। সে হিসাবে ১৩ জন মেয়রপ্রার্থীর মধ্যে ৯ জন তাদের জামানত হারিয়েছেন।

ভোট কম পাওয়ার হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে ইলিশ মার্কা নিয়ে ঢাকা দক্ষিণে সাঈদ খোকন পেয়েছিলেন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট। এবার দক্ষিণে নৌকার প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস পেয়েছেন ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫ ভোট। ২০১৫ সালে সাঈদ খোকনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাস মগ মার্কা নিয়ে ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট পেয়েছেন। এবার ধানের শীষের প্রার্থী ইশরাক হোসেন পেয়েছেন ২ লাখ ৬৫ হাজার ১২ ভোট।

২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত আনিসুল হক পেয়েছিলেন ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তাবিথ আউয়াল বাস প্রতীকে পেয়েছিলেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট।

এবার ঢাকা উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতিকুল ইসলাম নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৪ লাখ ৭২ হাজার ১১ ভোট। বিএনপি প্রার্থী সেই তাবিথ আউয়াল ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ২ লাখ ৪১ হাজার ৬১ ভোট। অর্থাৎ গত দুই সিটি নির্বাচনে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের হার কমেছে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সদ্যসমাপ্ত সিটি নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে কোনো প্রার্থী দিতে পারেনি। দক্ষিণে দলটির প্রার্থী হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন পেয়েছেন ৫ হাজার ৫৯৩ ভোট, যা দুই সিটির প্রদত্ত ভোটের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। তিনি ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে সোফা প্রতীকে ৪ হাজার ৫১৯ ভোট পেয়েছিলেন। এবার তার ভোটের হার কিছুটা বেড়েছে।

প্রচারণায় চরমোনাইয়ের পীর, ছবি: বার্তা২৪.কম

অন্য দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কেবল উত্তর সিটিতে প্রার্থী দিয়েছিল। দলটির আহাম্মদ সাজেদুল হক কাস্তে প্রতীকে পেয়েছেন ১৫ হাজার ১২২ ভোট। যা দুই সিটিতে প্রদত্ত ভোটের এক দশমিক ০৩ শতাংশ।

গণফ্রন্ট কেবল দক্ষিণ সিটিতে প্রার্থী দেয়। দলটির প্রার্থী আব্দুস সামাদ সুজন মাছ প্রতীকে পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৮৭ ভোট। দুই সিটিতে প্রদত্ত ভোটের শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ।

ন্যাশনাল পিপল পার্টির আম প্রতীকে দুই সিটিতে ভোট পড়েছে ৭ হাজার ৮টি। যা মোট প্রদত্ত ভোটের শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ। দলটির উত্তরের প্রার্থী মো. আনিসুর রহমান দেওয়ান পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৫৩ ভোট, আর দক্ষিণের প্রার্থী মো. বাহারানে সুলতান বাহার পেয়েছেন ৩ হাজার ১৫৫ ভোট।

বাংলাদেশ কংগ্রেসও কেবল দক্ষিণে মো. আকতারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহকে প্রার্থী দিয়ে ডাব প্রতীকে নিজেদের ঘরে তুলেছে ২ হাজার ৪২১ ভোট। দুই সিটির প্রদত্ত ভোটের যা শূন্য ১৬ শতাংশ।

প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি কেবল উত্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। দলটির প্রার্থী শাহীন খান বাঘ প্রতীকে পেয়েছেন ২ হাজার ১১১ ভোট, যা দুই সিটির প্রদত্ত ভোটের শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ।

দুই সিটির মধ্যে ডিএনসিসিতে ভোট পড়েছে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, আর দক্ষিণে ২৯ দশমিক ০৭ শতাংশ।

২০১৫ সালের বিভক্ত ঢাকার প্রথম নির্বাচনে উত্তরে ভোট পড়েছিল ৩৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর দক্ষিণে পড়েছিল ৪৮ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর