‘অপুর সংসার’ থেকে ‘অপর সংসারে’ সৌমিত্র

, বিনোদন

রাজীব নন্দী | 2023-09-01 10:50:43

করোনা এক কূলক্ষয়ী, কালক্ষয়ী, মহামারী। ফেলুদার সংলাপ ধার করে বলি, ‘এখন আর এটাকে নিরামিষ বলা যাবে না, বেশ পেঁয়াজ - রসুনের গন্ধ পাচ্ছি।’ করোনা মহামারীর মধ্যেই এলো কালজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবর্ষ। যদিও বছরের শুরুতেই ধেয়ে আসা করোনায় সবাই সঙ্গরোধ গৃহবন্দীত্বে চলে গেলাম। কিন্তু ন’মাস না ঘুরতেই ‘দুই হাজার বিশ সাল’টি চিনতে বাকি থাকলো না আর কিছু। ‘বিশে বিশ’ নয়, যেন ‘বিষে বিষ’ ক্ষয়! একে একে ছন্দপতন ঘটছে। তারই মধ্যে আজ ১৫ নভেম্বর ইন্দ্রপতন হলো বাঙলার তারাকালোকে কিংবদন্তী অভিনেতা, আবৃত্তিকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণে।

গত ৪০ দিন ধরে ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেলেন যেন। ঠিক যেন ব্যাগ গুছিয়ে নিশ্চিন্তে নিশ্চিন্দপুর থেকে বিদায় নেয়ার আগে বাকসো পেটরা গুছিয়ে নিচ্ছিলো অপু। আজ দুপুরেই ‘বেলভিউ- করোনা ডাউন লোকাল’ ট্রেনে চেপে বসলো অপু। এতক্ষণে নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। অপর্ণা, গত মাস দেড়েক ধরে অপেক্ষা করছিলো হয়তো এই মুহূর্তটির। কাজল, অনেক বড় হয়েছে নিশ্চয়, বহু বছর পর বাপ-বেটা দেখা আজ! 'দুগ্গাআআ' বলে বোনের পিছু নিয়ে পাড়া মাতাচ্ছে এতক্ষণে অপু!

ঝিন্দের বন্দী সিনেমায় সৌমিত্র

আজ সৌমিত্রের বিদায় বেলায় পিছু পিছু চলে গেলো আমাদের অপু, প্রিয় ক্ষিৎদ্দা, অমল চলে গেলো, ময়ূরবাহন ঘোড়ার খুড়ের টগবগ শব্দ বাজিয়ে চলে গেলো, সন্দীপ, অসীম সবাই একে একে চললো সৌমিত্রের ছায়া-মায়া মাড়িয়ে। পাঠশালা চালু রাখার নীরব প্রতিজ্ঞা করে সকলের কাছে বিদায় নিলেন উদয়ন পণ্ডিত! চলে গেলো প্রশান্ত, এই প্রথম ফেল করলো ফেলুদা! ফেলুদা মানে যে ফেল করে, অথচ ‘ফেলু’দা সকলের প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র, যার হেরে যাওয়া সাজে না। যথারীতি চোয়াল শক্ত করে যাকে দেখে নিজেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে বাঙালি-  ‘হয়ে আমি এর বদলা নেব না হলে গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব’। কিন্তু কে জানতো, আজ ‘ভয়ঙ্কর ভাইরাস’-এ কুপোকাত হবেন তিনি এবং জটায়ু তাঁর ‘স্যায়ামপ্রতিকতম উপন্যিয়াস’র জন্য নতুন প্লট পাবেন না আর। তোপসেও এবারের শীতে কোথাও যাবে না আর।

অপুর সংসার সিনেমার দৃশ্য

উত্তম কুমার নাকি সৌমিত্র? এমন একটি জটিল প্রশ্নের ঘোরপাকে একদিন একজনকে বলতে শুনি- ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে রোমান্টিক পথে তিনিই সৌমিত্র যিনি চলেন ভিন্ন ভিন্ন পথে’। হ্যাঁ, উত্তমের ছিলো চিররোমান্টিক রূপ। তার বিপরীতে সৌমিত্রের ছিলো বহুরূপ। অনেকটা পেঁয়াজের খোসার মতো একেকটি পরত। প্রতিটি পরতে এক একটি চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে সামনে মূর্ত হয়ে উঠতো। সৌমিত্রের জীবনের প্রথম সিনেমা ‘অপুর সংসার’। যে সিনেম ভারতীয় সিনে ইন্ড্রাস্ট্রিকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে যায়। সেই সিনেমায় একটি কালজয়ী সংলাপ বলে ডেব্যু ম্যাচে সেঞ্চুরি করার মতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন সৌমিত্র। তিনি বলেছিলেন, ‘সে পালাবেনা, escape করবেনা, সে বাঁচতে চায়, সে বলে তাঁর শিল্পের মধ্যেই সার্থকতা, শিল্পের মধ্যেই আনন্দ — he wants to live, he wants to write, he wants to sketch, he wants to act!’

হীরক রাজার দেশে সিনেমার উদয়ন পণ্ডিত

প্রিয় সৌমিত্র, তুমিই ফেলুদা, তুমিই ‘কাপুরুষ’, তুমিই আমাদের কৈশোরের ‘গণদেবতা’। এই বছরের শুরুতেই ‘অশনি সঙ্কেত’ পেয়েছিলাম। গত দেড়মাসে তোমার ‘মগজাস্ত্র’তে যে শান দিচ্ছিলে, তা আজ হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলো? ‘ঝিন্দের বন্দী’ দেশের রাজপুত্র ‘সোনার কেল্লা’ অভিযান করে কি তবে ‘বসন্ত বিলাপ’ ঘটালো? ‘ঘরে বাইরে’ আজ ‘গণশত্রু’ করোনা। অথচ তুমিই তো শিখিয়েছিলে কিভাবে উদয়ন পণ্ডিতের মতো শিড়দাঁড়া সোজা রাখতে হয় আর কিভাবে ফেলুদার মতো চোয়াল শক্ত করে পাল্টা চ্যালেঞ্জ নিতে হয়! করোনার ‘বেলাশেষে’ তুমি কি কেবল একজন ‘প্রাক্তন’? ভয়ঙ্কর করোনার প্রকোপে মন্দিরে নিজ দুয়ারে খিল এঁটে বসে আছেন ‘দেবী’। এমনকি ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ বলে যতই হাপিত্যেশ করি না কেন, কোন ‘নায়ক’ নেই যে আমাদের বাঁচাবে। ‘পোস্টমাস্টার’-এর যুগ শেষ, তাই এই অনলাইনেই তোমাকে চিঠি লিখলাম। এত তাড়াতাড়ি তুমি ‘সমাপ্তি’ টানবে কে জানতো? সুখেন্দু আজ মন খারাপ করে আছে, ভাবছে ‘সাত পাকে বাঁধা’ পড়া কি বড্ড জটিল একটি কাজ, অপুর সংসারে অপু যেমন বেহিসাবি স্বামী ছিলো।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

‘আকাশ কুসুম’ স্বপ্ন দেখতে দেখতে অজয় হয়তো ভাবছে ‘পরিণীতা’র শেখরের পরিণতি। করোনা মহামারীর পৃথিবীটার আসল স্বর শোনা গেলো ‘শাখাপ্রশাখা’র প্রশান্তের প্রলাপে। এদিকে করোনা রুখতে পৃথিবীব্যাপী ‘গণশত্রু’র বিরুদ্ধে ডা. অশোক গুপ্তরা লড়ছে, লড়বে! ‘অপুর সংসার’ ছেড়ে ‘তিন ভূবনের পারে’ অপর এক সংসারের ভিন্নজন হয়ে গেলেন সৌমিত্র। যার শারিরীক অনুপস্থিতি মোটেও প্রভাব ফেলবে না। এতটা বর্ণাঢ্য জীবন যার, তাঁর ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ বাঙালির চিরপাথেয় হয়ে থাকবে। বাঙালির সংকটে তিনি ফিরে ফিরে আসবেন আর বলবেন, ‘দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান’। বাঙালির সহায়ে তিনি বারবার বলবেন, ‘আমি ঘুষ নিই না মগনলালজী’। করোনার চাইতে রটনার শক্তিশালী পৃথিবীর গুজব, গণপিটুনিময় সহিংস সমাজে তিনি বারবার বলবেন, যার যার ‘মগজাস্ত্র’কে শান দিতে। জাদুকরের মতো যে বলবে, ‘আছে আছে, আমার টেলিপ্যাথি র জোর আছে। উৎসাহ দিতে গিয়ে বলবে, ‘শাবাশ তোপসে’। অপ্রিয় সত্যের মতো অমোঘ বাণী দিয়ে যাবেন তিনি বাঙালিকে বারে বারে ‘সত্যির উল্টো টা তো মিথ্যাই হয়’। আর যত দুষ্ট লোক, তাঁদের জন্য রইলো সেই বিখ্যাত সংলাপ- ‘আপনার পিঠে যেটা সুড়সুড়ি দিচ্ছে, সেটা আগ্নেয়াস্ত্র। অতএব, পালাবার চেষ্টা করা বৃথা।’ অবাক হওয়ার অভিনয় করে কেউ এসে আমাদের শৈশবকে বলবে ‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক এর মত একজন লোক থাকতে এ বাড়ি থেকে গণেশ টি চুরি হয়ে গেলো?’

চারুলতার অমল

সব মিলে রহস্যের পরতে পরতে অপূর্ব রোমাঞ্চকর এক গল্পে ভিন্ন চরিত্র সৌমিত্র! সৌমিত্রের মৃত্যু সংবাদে ‘মিত্র ভূত’টি শিরদাড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে আমার ধীরে ধীরে।  পেঁয়াজের খোসার মতো একেকটি পরতের পর পরতে নানান চরিত্রের সৌমিত্র। সৌমিত্রের সাথে তাই আমার অনিঃশেষ অপূর্ব মিত্রতা। ‘ময়ূরাক্ষী’র পাশে ‘সাঁঝবাতি’ নিভিয়ে দাও আজ। দীপাবলির সব আলো নিভিয়ে দাও! কালো আকাশের বুকে আজ উজ্জ্বল শুধু একটি তারা- সৌমিত্র! ‘এত আনন্দ আয়োজন/ সবই বৃথা তাঁকে ছাড়া... ভরে থাকুক আমার মুঠো/ দুই চোখে থাকুক ধারা’!

রাজীব নন্দী: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর