সূর্য দীঘল বাড়ির কাসু

সিনেমা, বিনোদন

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 06:11:43

সূর্য দীঘল বাড়ির জয়গুনের কিশোর ছেলে হাসু স্টেশনে কুলির কাজ করে দিনে কয় পয়সা আয় করে। দুবার সংসার ভেঙে এখন ছেলে আর মেয়ে মায়মুনকে নিয়ে অপয়া এক ভিটায় পূর্ব পশ্চিমের ঘর বাঁধে জয়গুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দূর্ভিক্ষে যখন দেশজুড়ে আকাল আর ক্ষুধার কষ্ট নিজেকে আর সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে লড়াই করে যাচ্ছেন জয়গুন। ট্রেনে ময়মনসিংহ থেকে কম দামে চাল কিনে এনে বিক্রি করেন। স্বচ্ছলতার আশায় অন্যের বাড়িতে কাজ করেন।

মেয়ে মায়মুন হাঁস পালে। জয়গুনের পর্দা নেই বলে সেই হাঁসের ডিম রাখতে রাজি হলেন না জুমার মসজিদের ইমাম। সন্তানের সামনে অবলীলায় মায়ের চরিত্র নিয়ে অভিযোগ তুললেন ইমাম, ফিরিয়ে দিলেন ডিম ৪ টি। আবু ইসহাক ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত 'সূর্যদীঘল বাড়ি' উপন্যাসে পরের ঘটনাগুলো লেখেছেন এভাবে,

'হাসু রেগে ওঠে মনে মনে। একবার ইচ্ছে হয়- দেয় ছুঁড়ে ডিম কয়টা ইমামের মুখের ওপর। কিন্তু সাহস হয় না। ডিম ক'টা নিয়ে সে বেরিয়ে আসে।

কোষাটাকে সে জোরে বেয়ে নিয়ে যায়। আজ অনেকগুলো ট্রেন ও স্টিমার ফাঁকা গেল। দুটোর জাহাজ ধরা চাইই চাই। দুটো মোট পেলেও ছ'আনার কাজ হবে।

দুটোর জাহাজ আর বিকেল পাঁচটার ট্রেন ধরে সে আসে বাজারে। ডিম চারটে সে বিক্রি করেই ফেলবে। কেন দেবে সে মসজিদে? মা জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে, জুম্মার ধরে দেয়া হয়েছে।

ডিম ক'টা সাত আনায় বেঁচে সে পাঁচ আনায় চারগাছা কাচের চুড়ি কেনে মায়মুনের জন্যে, আর নিজের কোমরে পয়সা বেঁধে রাখবার জালি কেনে একটা। বাকি দু'আনার এক আনায় কেনে একটা চরকি ও অন্য এক আনায় চারটে তিলের কদমা।

সন্ধ্যার দিকে সে কোষা ভিড়ায় একটা বাড়ির ঘটে। চারদিকে চেয়ে সে চুপিচুপি ডাকে-কাসু, অ- কাসু! 

বছর সাতেকের একটি ছোট্ট ছেলে লাফিয়ে লাফিয়ে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। হাসু ওকে কোলে তুলে নেয়। তারপর ওর মুখে একটা কদমা দিয়ে বলে-দ্যাখ, কেমুন মিষ্টু। এই চরকিডাও তোর লাইগ্যা আনছি। দ্যাখ, কেমুন সোন্দর ঘোরে। কাসু খুশি হয় খুব। হাসু বলে- যাবি তুই আমার লগে? মা তোর লাইগ্যা কত কান্দে দিন-রাইত!

-ক্যার মা?

-তোর মা। আমার মা।

-হুঁ, মিছা কথা।

-না বলদ, সত্যই।

মা-র কথা শুনে কাসু যেন কেমন হয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তার চোখ টলটল করে। কাসু কি কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে জানে, তার মা মরে গেছে। বাপ তো সেই কথাই বলে সবসময়।

-যাইমু তোমার মা-র কাছে-কাসু বলে।

-আমার মা যে তোরও মা অয়, বলদ।'

উপন্যাস কিংসা পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত ছবিটিতেও এই সময় ঘটনাস্থলে হাজির হন করিম বকশ। কাসুকে কোল থেকে নামিয়ে যাওয়ার সময় হাসু বাকি তিনটে কদমাও দিয়ে যায়। করিম বকশ হাসুকে খেড়িয়ে ছোট কাসুর ওপর রাগ ঝাড়েন। কান্না আসে হাসুর। 'কাসু যে তারই ভাই। এক মা-র পেটের ভাই। হোক না বাপ ভিন্ন।'কিন্তু মা তো একজনই।'

শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, চলচ্চিত্র হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছে 'সূর্য দীঘল বাড়ি।' পুরো সিনেমায় প্রত্যেকটি চরিত্রের নিখুঁত অভিনয় দেখে কখনোই অভিনয় মনে হবে না। ডলি জহুর, আনোয়ার, রওশন জামিল, সৈয়দ হাসান ইমাম সকলেই যেন ওই চরিত্রেই নিজেদের সৃষ্টি করেছেন। আর ৭ বছরের কাসুর চরিত্রে সজীবের অভিনয় সত্যিই ছিল অনবদ্য। মায়াবী চেহারা আর সরলতায় ভরা তার দৃষ্টি সূর্যদীঘল বাড়ির দর্শকদের মনে গেঁথে থাকে দীর্ঘকাল। মুখে কদমা ঢুকিয়ে যখন কামড় দেয় সেই দৃশ্যের চিত্রায়ন যেন অসাধারণ এক বাস্তবতার শিল্প।

সূর্যদীঘল বাড়ি গ্রামীণ প্রান্তিক দরিদ্র শ্রেণীর জীবনের পটভূমির উপর রচয়িত। যেখানে রয়েছে নারীর পদে পদে বাঁধা, নিদারুণ অভাব, কুসংস্কার, বাল্য বিবাহ, শিক্ষার অভাব। সেই পটভূমিতে নির্মিত ছবির সাদা কালো ফ্রেমেও যখন হাফ প্যান্ট পড়ে খালি পায়ে কাসু ছুটে চলে- এ দৃশ্য যেন সত্যিই অযত্নে বেড়ে ওঠা এক শৈশব। অথচ মা জয়গুনের, ভাই হাসু আর বোন মায়মুনের অতি আদরের এই কাসু। জয়গুনকে খেঁদিয়ে দিলেও সেই সময় ৩ বছরের ছেলে কাসুকে নিজের কাছে রেখে দেয় করিম বকশ।

একসময় মায়ের কাছে যেতে চায় কাসু। বিশেষ করে যখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে, মায়ের স্নেহ আর সেবায় সেরে ওঠে সে। আদরের ছেলে কাসুকে সুস্থ করে তুলতে সতীন থাকলেও করিম বকশের ঘরে ওঠেন জয়গুন। কাসুকে সুস্থ করে তুলতে ডাক্তার আনার জন্যে মায়মুনের হাঁস দুটো বিক্রি করে দিতে এক মুহূর্তও ভাবেনি জয়গুন।

চলচ্চিত্রে মায়ের আদরের কাসু যখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বা মায়ের বাড়ি যাওয়ার জন্যে আবদার করতে থাকে, তার আকুঁতি যেন দর্শকের হৃদয়কেও নিংড়িয়ে দিয়ে যায়।

মাতৃস্নেহে জয়ে মায়ের কোলে ফিরে আসে কাসু। যে ঘরে এক বেলার খাবার জোগাড় করাই কষ্টসাধ্য সেখানে আরো একটি নতুন মুখ! তবে এরপরও কাসুর জন্যে বাকিতে দুধ আনতে বাঁধে না মা জয়গুনে।

কাসুর বেড়ে ওঠা নিয়ে আবু ইসহাক লিখেছেন,

জয়গুনকে ছেড়ে দেয়ার পর কাসুকে নিয়ে করিম বকশ বিব্রত হয়েছিল। একদিন করিম বকশের এক নিঃসন্তান বোন এসে কাসুকে নিয়ে যাওয়ায় সে নিশ্চিত হয়।

কাসু ফুপুর বাড়িতে এক রকম ভালই ছিল।

কিছুদিন আগে ফুপু মারা যাওয়ার পর করিম বকশ তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে এসেছে। কিন্তু এ বাড়ির ঝগড়াটে আবহাওয়ায় এসে কয়েক দিনেই সে মন-মরা হয়ে গেছে। এখানে আদর করে কেউ কোলে নেয় না তাকে। ডাকেও না কেউ। এখানে কারো মুখেই হাসি নেই। তাই ওর নিজের হাসিও কোথায় মিলিয়ে গেছে! কারো মুখের দিকে চেয়েই সে ভরসা পায় না। শুধু একজনকেই তার পছন্দ হয়েছে। সে হাসু। তার এখানে আসবার পর সে তিনদিন এসেছে। কিছুদিন ধরে তারও দেখা নেই। 

কাসুর মধ্যে ধীরে ধীরে মায়ের প্রতি টান বাড়তে থাকে। সেটা বুঝতে পারে করিম বকশ। তার ভাবনায়, 'ছেঁড়াটা ভারি ফেরেববাজ।'

বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি সূর্যদীঘল বাড়ি। আর চলচ্চিত্রেও যা অনুকরণীয়। আর সেই ঘটনায় কাসু চরিত্রটি যে কারো মনকে যেমন তৃপ্ত করে আবার হাহাকারে ভরিয়ে তোলে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর