সেলফি তুলেই বকশিস চায় কাঙালিনী সুফিয়া

বিবিধ, বিনোদন

এস এম জামাল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 02:36:54

১৯৬১-তে জন্ম নেওয়া এ মানুষটির মুখে এখনো লেগে আছে মায়ামাখা হাসি। কিন্তু এই সহজ-সরল মানুষটির পথ চলা তেমন মসৃণ ছিল না। একজন টুনি হালদার থেকে কাঙালিনী সুফিয়া হয়ে ওঠার গল্পটা অনেক কষ্টের। এসব নিয়েই কথা হয়েছে তার সঙ্গে।

বৃহস্পতিবার (১১ অক্টোবর) কুষ্টিয়া স্টেডিয়ামে ছিল উন্নয়ন কনসার্ট। সেই কনসার্টে মমতাজ, বাপ্পা মজুমদার, শফি মণ্ডলসহ নামীদামি তারকার সঙ্গে কাঙালিনী সুফিয়ারও গান করার কথা ছিল। কিন্তু বিধিবাম, বৈরী আবহাওয়ার কারণে স্থগিত করে দেওয়া হয় অনুষ্ঠান। আয়োজক কমিটি ঘোষণা দেয় অনুষ্ঠান স্থগিত। পরবর্তীতে এর তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে।

অনুষ্ঠানস্থলে আসা দর্শকদের ফিরিয়ে দিচ্ছিল আয়োজক কমিটি। এ সময় বাউল শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়া মানুষকে ধরে ধরে বলছে ‘তোরা ছবি তোল, আর বকশিস দে আমাকে’।

‘পরানের বান্ধব রে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে’ গানটি এক সময় মানুষের মুখে মুখে ঘুরত। দরাজ গলায় সেই গানটি গাওয়ার শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়ার ছবিটা ভেসে উঠত মনের অজান্তে। এরপর সময় পেরিয়ে গেছে বহু বছর। কাঙালিনীর বয়স বেড়েছে, গায়ের তেজটাও নেই আগের মতো। এরপরও গাইছেন। কিন্তু সেটা যতটা মন থেকে, তার চেয়ে বেশি জীবনের প্রয়োজনে।

এদিকে অনুষ্ঠানস্থলে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে কথা হয় কাঙালিনী সুফিয়ার। তিনি বলেন, ‘এখানে আইসা দেখি বৃষ্টির কারণে গানের অনুষ্ঠান বাতিল। অনেকেই আমার সঙ্গে ছবি তুলছে। তাই মানুষদের বলছিলাম অনুষ্ঠান না করলে ট্যাকা পামু না। ছবি তোল আর বকশিস দে।’

কাঙালীনি সুফিয়া তার কষ্টের কথা বলতে গেলে মুহূর্তেই মুখটা মলিন হয়ে যায়। নারী পুরুষের এই সমাজে এখনো বৈষম্য রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি যখন ‘পরানের বান্ধব রে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে’ গানটি গাই তখন আক্ষেপ করেই কিছু কথা বলে ফেলি। আমরা মেয়েছেলে (নারী) কতোই না কষ্ট করি। এখনো আমাদের সমাজের নারীরা পুরুষদের চোখে অবহেলিত। বেতনসহ আরও কতো বৈষম্যই না রয়েছে।’ এসব বলেই শুরু হয়, তার গান। ‘কত কষ্ট কইরা আমি, কামাই রোজগার করি, তবুও বুড়োর মন পাইলাম না, ‘পরানের বান্ধবরে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে।’

আবার সুখের কথাতেও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়েন এই শিল্পী।

১৯৬১ সালে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির রামদিয়া গ্রামে জন্ম কাঙালিনীর। তবে তার নাম টুনি হালদার। এই টুনি হালদার থেকে কাঙালিনী সুফিয়া হয়ে ওঠার অনেক গল্প আছে।

তার বাবা খোকন হালদার আর মা টুলু হালদার। তাদের ইচ্ছায় সুধীর হালদার নামের এক বাউলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর কোল জুড়ে এক কন্যা সন্তান আসে। নাম রাখা হয় পুষ্প।

তবে স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে একমাত্র মেয়ে পুষ্পকে কোলে নিয়ে ঘর ছাড়েন কাঙালিনী। প্রথমে ভেবেছিলেন বাবার বাড়িতে যাবেন। কিন্তু অভিমান করে সেখানেও যাননি। বেছে নেন ভবঘুরে জীবন। এ সময় পরিচয় হয় বেলগাছির লালন সাধক দেবেন ক্ষ্যাপার সঙ্গে।

দেবেনের কাছেই গানের প্রথম তালিম নেন সুফিয়া। এটা ছিল অন্য রকম জীবনযুদ্ধ। তারপরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

স্বাধীনতা যুদ্ধে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের রানাঘাটের লালগুলা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন সুফিয়া। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এলেও কপাল ফেরেনি তার। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান।

প্রথমে হাইকোর্ট আর শাহ আলীর মাজারই ছিল তার ঘরবাড়ি। এখানে ওখানে গান গাওয়ার ডাক এলে ছুটে যেতেন। একদিন শিল্পকলা একাডেমির একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে যান। সেখানে গিয়েই সুফিয়া হয়ে যান কাঙালিনী সুফিয়া।

কীভাবে এটা সম্ভব হল এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তখন শিল্পকলা একাডেমির ডিজি (মহাপরিচালক) ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার। তিনি আমার গান শুনে নাম দেন ‘কাঙালিনী’। সেই থেকে আমার নামের আগে কাঙালিনী যোগ হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই দেশ-বিদেশ থেকে গান গাওয়ার ডাক আসতে থাকে।’

প্রথমদিকে অল্প কিছু সম্মানীর বিনিময়ে গান করলেও কাঙালিনী সুফিয়ার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সব কিছু পাল্টে যায়। কাঙালিনী সুফিয়ার ভাষায়, ‘শুরুর দিকে তিনশ টাকার জন্য সারা রাত গান গাইছি। তারপর অবস্থার একটু উন্নতি ঘটল, তখন কেউ পাঁচশ, কেউ এক হাজার টাকা দিত। আর এখন তো গান গাইতে গেলে অনেক টাকা দেয়। তবে এখন বেশির ভাগ টাকাই পার্টি খেয়ে ফেলে। তাই কাঙালিনীর অভাব যায় না।’

কাঙালিনী সুফিয়া সেই ১৪ বছর বয়স থেকে গান গাওয়া শুরু করেন। বয়স ৫৭ পেরিয়েছে অনেক আগেই। তাই সব সময় দূর-দূরান্তে গিয়ে গান গাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। কুষ্টিয়ার লালন একাডেমীসহ বিভিন্ন এলাকায় একাগ্রচিত্তে গান গেয়ে যান তিনি। গান পরিবেশনের এক ভিন্নমাত্রার ঢং রয়েছে তার মধ্যে। যা মানুষকে আকর্ষণ করে আসছে বহু বছর ধরে।

এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তো গুরু বিদ্যায় বিশ্বাসী। যার কারণে আমার মধ্যে সাধন-ভজন বিষয়টি এখনো কাজ করে। আর এ বিষয়টিকে পুঁজি করেই বেঁচে রয়েছি। গান তো আমার শরীরের প্রত্যেকটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে। যার কারণে অভিমান হয়নি কখনো। যতদিন বেঁচে আছি এভাবেই থাকব।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর