তারেক মাসুদের কাছে খোলা চিঠি

সিনেমা, বিনোদন

প্রসূন রহমান, অতিথি লেখক | 2023-08-20 05:26:11

নন্দিত নির্মাতা তারেক মাসুদের ৬৫তম জন্মদিন আজ (৬ ডিসেম্বর)। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তিনি ছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এক পথিকৃৎ। ‘মাটির ময়না’ (২০০২) তার প্রথম ফিচার চলচ্চিত্র যার জন্য তিনি ২০০২-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন এবং এটি প্রথম বাংলাদেশি বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে একাডেমি পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

তারেক মাসুদের পরিচালিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সোনার বেড়ি (১৯৮৫)এবং সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র রানওয়ে (২০১০)। এছাড়াও তিনি নির্মাণ করেছেন আদম সুরত, অন্তর্জাত্রা, মুক্তির গান প্রভৃতি। চলচ্চিত্রে তাঁর অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে। তাঁর দীর্ঘদিনের নির্মাণসঙ্গী ‘সুতপার ঠিকানা’খ্যাত নির্মাতা প্রসূন রহমান। সহযোগি হিসেবে কাজ করেছেন  ‘নরসুন্দর’, ‘রানওয়ে’সহ বেশকিছু চলচ্চিত্রে। সর্বশেষ  ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্রের গবেষণা কাজে তারেক মাসুদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট এ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের লোকেশন দেখে ফেরার পথে মানিকগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে তারেক মাসুদের।
জন্মদিনে প্রিয় নির্মাতার কাছে বার্তা ২৪.কমের মাধ্যমে প্রসূন রহমান লিখেছেন খোলা চিঠি।

তারেক মাসুদ ও প্রসূন রহমান




প্রিয় তারেক ভাই,

বেঁচে থাকতে আপনি জন্মদিন পালন করতেন না কখনো। কিন্তু আপনাকে হারিয়ে ফেলার পর এবছরই প্রথম আপনার জন্মদিন উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান নেই। কোনো উদযাপন হচ্ছেনা কোথাও। বেঁচে থাকলে এবছর আপনার ৬৫ বছর পূর্ণ হতো। কেমন হতো আপনার জীবনভাবনা এই সময়ে?

আপনার কোনো ফেসবুক প্রোফাইল ছিল না তখন। এখন কী থাকতো? সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়া ফোনকলের রেকর্ড কী শোনা হতো আপনার? এসব শুনে আপনারও কী মনে হতো, ডিসেম্বরের বৃষ্টি কী বিষাদের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে?

কিংবা নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের পথে নামা? গত ১১ মাসে সড়কে প্রাণ হারিয়েছে ৭৩৭ জন শিক্ষার্থী। শুধু নভেম্বরেই গাড়ির চাকায় পিষ্ট হযেছে ৫৪ জন ছাত্র। এই প্যান্ডেমিকের কালেও সড়ক দুঘর্টনায় এ বছর প্রাণ হারিয়েছে সব মিলিয়ে ৫ হাজারের উপরে। মিশুক ভাইসহ আপনাকেও সড়ক দুর্ঘটনাতেই হারিয়েছি। তাই দূর্ঘটনার খবর শুনলেই বুকটা কেঁপে ওঠে। যে নৈরাশ্যজনক অবস্থা থেকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যূর গ্যারান্টি চাই’ এর মতো বিদ্রুপাত্মক শ্লোগান তৈরী হয়েছিল, সে নৈরাশ্যের ঘের এখনো কাটেনি।

ইলিয়াস কাঞ্চন একা একা বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেছেন, তবু থামেননি। বড়দের কেউ আর এসব নিয়ে কথা বলেনা। এখন ছোটোরা বলার চেষ্টা করছে ২০১৮ সাল থেকে। কিন্তু ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর লাইসেন্সবিহিন চালকের সংখ্যা একটুও কমছেনা।

ভাবছিলাম, বেঁচে থাকলে কী করতেন এই সময়টায়? কোন ছবি নির্মাণের কথা ভাবতেন? কোন বিষয়ে? কাদের জন্যে? কোথায়, কোন মাধ্যমে প্রদর্শিত হতো আপনার ছবি?

ওটিটি প্লাটফর্মগুলো কি ডাকতো আপনাকে? কীভাবে দেখতেন আপনি তাদের এই ‘ক্রাইম থ্রিলার’ নামের ক্রাইম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি? কীভাবে নিতেন অপরাধ ও নৃশংসতাকে বিনোদনের মোড়কে পূণঃনির্মাণের নামে এই প্রযুক্তি নির্ভর সাংস্কৃতিক অনাচার?

প্রেক্ষাগৃহে আপনার সিনেমা মুক্তি পেতো না। তবু সিনেমা হল বাঁচানোর প্রয়োজনীয়তার কথা, মানুষের জীবনে সুস্থ বিনোদনের প্রয়োজনীয়তার কথা জানানোর চেষ্টা করেছেন অনেকভাবে।

২০১১ সালেও আপনি ২৫০টি হল ছিল দেখে গেছেন, এখন ঠিকভাবে ৫০টিও আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু সমিতি আছে অনেকগুলো।

আপনার নিকটতম বন্ধু ও সহকর্মীদের মধ্যে মোরশেদ ভাই হৃদযন্ত্রে বাইপাস সার্জারির ধকল কাটিয়ে উঠেছেন অনেকটাই। নতুন নির্মাণের কথা ভাবছেন নিশ্চয়ই। তানভির ভাই সক্রিয় আছেন ফিকশন-ননফিকশন দুই ধারাতেই। মুরাদ ভাই অসুস্থতা কাটিয়ে নতুন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা বঞ্চিত হলাম আপনার নির্মাণ থেকে।

আপনার জেনে ভালো লাগবে, অনেক সৃজনশীল তরুণ প্রাণ আপনারই হেঁটে যাওয়া পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে অনেকদুর। নিজেদের নির্মাণ নিয়ে অনেকেই পৌছে যাচ্ছে বিশ্ব দরবারের সম্মানজনক সব উৎসবে। সমীহ আদায় করছে নিজের দেশের জন্যে। দেশের হাতে গোণা কয়েকটি সিনেপ্লেক্সেও অন্যধারার ছবিগুলোই গুরুত্ব পাচ্ছে সবদিক থেকে।

আপনি বলতেন, একজন নির্মাতার পরিণত হয়ে উঠতে উঠতে যখন তার সবচাইতে সেরা কাজটি করবার সময় আসে ততদিনে তার বয়স হয়ে যায় ৫০। আর এই দেশে ৫০ পেরিয়ে যাওয়ার পরই শারীরিক সামর্থ্য ধীরে ধীরে কমে আসে আর দিন গুনতে হয় মৃত্যুর। কিন্তু আপনি তো ৫৪তেও পুর্ণোদ্যমে সক্রিয় ছিলেন, ছিলেন তারুণ্যে ভরপুর এক সতেজ প্রাণ। কালের দিনলিপিতে আপনাকে হারানো তাই দগদগে ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে।

মিশুক ভাইকে নিয়ে ওপারে কেমন আছেন জানিনা। ওপারে কে কেমন থাকে, কারো পক্ষে জানা সম্ভব হযনি কখনো। তবুও প্রত্যাশা, আপনারা ভালো আছেন।

আমাদের প্রজন্মকে যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রায় ভুলিয়ে দেয়া হয়েছিল, তখন হঠাৎই আপনি আর ক্যাথরিন হাজির হয়েছিলেন- ‘মুক্তির গান’ নিয়ে। আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের কালে আপনাকে আরেকবার সালাম জানাই। জন্মদিনের শুভেচ্ছা নেবেন।

ইতি,
আপনার স্নেহধন্য
প্রসূন রহমান
৬ ডিসেম্বর, ২০২১

এ সম্পর্কিত আরও খবর