সিনেমায় নিজস্ব বলার ভঙ্গি সৃষ্টি করাটাও একটা যুদ্ধ : আতিক

সিনেমা, বিনোদন

রুদ্র হক, বার্তা ২৪.কম | 2023-08-30 23:32:15

এগারো বছর পর বড়পর্দায় ফিরলেন নন্দিত নির্মাতা নুরুল আলম আতিক। বড়পর্দায় চলছে তার নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। ২০১০ সালের পর দীর্ঘ বিরতি নিয়ে বড়পর্দায় প্রত্যাবর্তন ও মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ নিয়ে বার্তা২৪ এর সাথে বিস্তারিত কথা বলেছেন তিনি।


এতদিন পর আপনি আবার বড় পর্দায় ফিরলেন। অনুভূতিটা জানতে চাই...

নুরুল আলম আতিকঃ আসলে এখন মনে হচ্ছে একটু দম নিতে পারছি। এইটকুনই। এই সংসারে আমি এতকাল ধরে আছি। এই যে ছবি দেখাতে পারছি এইটাই শুকরিয়া। একটা শ্বাসরুদ্ধকর সময় গিয়েছে এই ৫/৬ টা বছর। এই যে ছবি শেষ হচ্ছিল না। দেখাতে পারছিলাম না। এমন একটা হতাশাময় সময়ের শেষে আজকে মনে হয় একটু দম নিতে পারছি। মানুষকে আমন্ত্রণ জানাতে পারছি- যে ছবিগুলো সৃষ্টি হচ্ছিল সেগুলোর কাজ শেষ হচ্ছে। আপনারা দেখতে আসেন।

‘মানুষের বাগান’, ‘পেয়ারার সুবাস’সহ আপনার বেশ কিছু ছবির কাজ চলছে। সেখান থেকে ‘লাল মোরগের ঝুটি’ টা সবগুলোর আগে মুক্তি পেল। নির্মাণশৈলীর জায়গা থেকে এই ছবিটাকে কতটা এগিয়ে রাখবেন আপনি?

নুরুল আলম আতিকঃ এই প্রশ্নের জবাব আসলে সেরকম ভাবে দেওয়া মুশকিল। ৩ টা ছবির কাজ আসলে একসাথেই চলছিল। প্রথমে অবশ্য ‘লাল মোরগের ঝুটি’ দিয়েই শুরু করেছিলাম। তারপর ‘পেয়ারা সুবাস’ এবং তারপরে ‘মানুষের বাগান’। ‘মানুষের বাগান’টাও কমপ্লিট। আর ‘পেয়ারা সুবাস’-এর কাজও একেবারে শেষ পর্যায়ে।

আশা করি, খুব শীঘ্রই আমরা এই ছবিগুলোও দর্শককে দেখাতে পারবো, নির্মাণশৈলীর জায়গা থেকে আমার মনে হয়, দর্শকরাই বিচার করবেন। ৩টা ছবি তো আসলে আমার ৩ সন্তান।

তাই কাউকে আগে কাউকে পিছে আমি রাখতে পারবো না। দর্শকরাই এর বিচার করবেন। দর্শকরা যদি ‘লাল মোরগের ঝুটি’ ছবি দেখে, এর চিন্তাভাবনার সাথে নিজেদের কানেক্ট করতে পারে, তাহলেই তো ছবি সফল হবে।

তারপরও গল্পের গুরুত্বের জায়গা থেকে ‘লাল মোরগের ঝুটি’কে কতটা এগিয়ে রাখবেন?

নুরুল আলম আতিকঃ বাংলাদেশের ইতিহাসকে নিয়ে অডিও-ভিজ্যুয়ালে কাজ করাটা আসলে আমার কাছে একটা নৈতিক দায়িত্বের মাঝে পড়ে। এখন আমি ছবিটা বানাতে কতটা সফল হলাম, সেইটা আপনাদের এবং দর্শকের মতামতের উপর নির্ভর করে।


মানে, আপনি বলতে চাইছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র করাটা আপনার জন্য একটা দায়বদ্ধতা ছিল?

নুরুল আলম আতিকঃ
হ্যা, নিশ্চয়ই।

দর্শক-বিবেচনার ব্যাপারটা একপাশে রেখে আমরা জানতে চাচ্ছি যে, নির্মাতা হিসাবে আপনি মুক্তিযুদ্ধকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শকদের দেখাতে চেয়েছেন?

নুরুল আলম আতিকঃ মুক্তিযুদ্ধ আসলে বিচিত্র সম্ভাবনার জায়গা। অসংখ্য না জানা গল্প আছে যেগুলোকে আলোতে আনবার দরকার আছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগেও ছবি হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। নির্মাতারা নিজেদের নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখাবেন।

‘লাল মোরগের ঝুটি’র গল্প আসলে আমার ছেলেবেলায় শোনা বিভিন্ন গল্পের নির্যাসে তৈরি। আর বহুবছর ধরে চলচ্চিত্রের কাজে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতাও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এছাড়া যেহেতু আমি এয়ারপোর্টের কাছাকাছি থাকি, তাই এয়ারপোর্টের ব্যাপারটা আমার মাথায় এসেছে। আমাদের সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে অসংখ্য বাঙালিকে বন্দী করে তাদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবার যে অসৎ-উদ্দেশ্য ছিল, তাঁদের উপর করা অত্যাচার, তাঁদের দুঃখ-কষ্টের গল্প থেকেই আমি এই ছবিটা নির্মাণ করেছি। এই গল্পটা হয়তো মুক্তিযুদ্ধের সাথে দর্শকদের নতুনভাবে কানেক্ট করবে।

আমরা তো মুক্তিযুদ্ধের ছবি মানেই বুঝি গেরিলাযুদ্ধ কিংবা সমরাস্ত্রের ঝনঝনানি। আপনার এই ছবিতে তা নেই। এই ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

নুরুল আলম আতিকঃ হ্যাঁ। সেইরকম ছবিও হচ্ছে, এবং হবে। যুদ্ধ মানে সম্মুখ সমর থাকবেই। কিন্তু এই ছবিতে আপনি দেখতে পাবেন যুদ্ধে যখন গণহত্যাকান্ডে একজন নিম্নবর্গের মানুষের চোখের সামনে তার পিতাকে হত্যা করা হয়, এবং তারপর বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সেই মানুষটি ‘ফাইটব্যাক’ করে। দেখেন যুদ্ধে তো বহু সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছিল। অনেকের নাম হয়তো আমরা এখনও জানি না। এরকম সব জীবনের গল্প নিয়েই আমাদের ছবি।


চমৎকার। ‘লাল মোরগের ঝুটি’ নামটা কেন হলো তা যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন?

নুরুল আলম আতিকঃ এইটা যদিও শহীদুল আলমের লেখা মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গল্পের নাম। গল্পটার নাম থেকেই প্রথমে এই নামটা মাথায় আসে। তাছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে যে ভাবনা থেকে এই নামটাই নিয়েছি তার গল্প আলাদা। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মোরগ-যুদ্ধ থেকে আমোদ-ফূর্তি করতো। এয়ারপোর্টের রানওয়েতে এরকম মোরগ-যুদ্ধের আয়োজন হতো। তো এটা আরেকটা কারণ। এটা আসলে রূপক-অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে ‘লাল’ শব্দটা নতুন সূর্যকেও বোঝায়। নতুন দিনে নতুন সূর্যে যখন মোরগ ডাকে তখন তো তার মাথাটা উঁচু হয়। আর ‘ঝুটি’ তো উঁচু করা মাথার উপরেই থাকে।

বাঙালি তো আসলে যোদ্ধা জাতি নয়। এই দেশের উর্বর মাটি আর চমৎকার আবহাওয়া তো বাঙালিকে একটু অলসই করে দিয়েছে। বাঙালির হয়তো জমি জিরাত বিষয়ক মামলামকদ্দমা আর ঝগড়াঝাটির অভিজ্ঞতা ছিল। রাজনৈতিকভাবে তো এর আগে তেমন বেশি সচেতন বাঙালি ছিল না। কিন্তু সেই জাতিরই খেটে-খাওয়া মানুষেরাই তো জাতিসত্তা রক্ষার জন্য ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সুসংহত আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। এইসব ব্যাপার মাথায় রেখেই এই নামকরণ করা হয়েছে।

আর সবার মতো আমাদেরও প্রশ্ন, সিনেমাটা আসলে সাদাকালো কেন?

নুরুল আলম আতিকঃ
আপনি সিনেমাটা দেখে যদি রঙের অভাব বোধ করেন তবে আমাকে জানাবেন। তখন না হয় রঙিন আরেকটা ভার্সন বানাবো!

না আমার কাছে কালারটা চমৎকার লেগেছে। সাদা-কালো'র বাইরে আসলে আমি সিনেমাটা ভাবতে পারি নাই।

নুরুল আলম আতিকঃ
দেখেন, চারদিকে রঙেরই বাহার। তবে সাদাকালোর মাঝেই তো সব রঙ লুকিয়ে আছে তাই না? যেহেতু আমরা অতীত দিনের গল্প বলছি তাই সাদা-কালো রঙটাই এখানো সবচেয়ে উপযুক্ত।

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের চলচ্চিত্রের আকাঙ্খা আমাদের সবসময়ই ছিল এবং আছে। বাংলাদেশে তো অনেক মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক চলচ্চিত্র হয়েছে, আপনিও নির্মাণ করলেন। তো চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট?

নুরুল আলম আতিকঃ আমার জীবদ্দশায় যে আমি ছবিটা মানুষকে দেখিয়ে যেতে পারতেছি এইটাই আমার সন্তুষ্টি। গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের কথা যা বললেন, তা তো চলছেই। একেকজন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ফুটিয়ে তুলছে। এবং এই ব্যাপারটা এরকমভাবে চলতেই থাকবে। আর যুদ্ধের সিনেমা বানানোটাও তো যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু নয়। সিনেমায় নিজস্ব বলার ভঙ্গি সৃষ্টি করাটাও যুদ্ধ। এই ছবিগুলোতে প্রশ্ন জাগবে।

কেন হাতে লেখা ব্যানার মানুষের হাতে? আমরা তো অতীতকে বিসর্জন দিয়ে ভবিষ্যতে যেতে পারবো না। অতীতের সাথে বর্তমানের সম্পর্কটাই ভবিষ্যতকে নির্দেষ করবে। সেই জন্যই মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটা জরুরি আমাদের জন্য। নতুন প্রজন্ম যদি অতীতকে ‘রিড’ করতে পারেন, তবেই তারা ভবিষ্যতকে ‘রাইট’ করতে পারবেন।


দর্শকদের জন্য কী বলবেন?

নুরুল আলম আতিকঃ দর্শকদের আমন্ত্রণ রইলো। আপনারা হলে আসুন। দেখুন ছবিটা। এই ছবির যে সাউন্ড-সিস্টেম আর আলো-আঁধারের খেলা, এইটা হলে বসে দেখার জন্য। হলে বসে দেখলে আপনাদের বিরল অভিজ্ঞতা হবে। আপনারা আসুন।

অসংখ্য ধন্যবাদ আতিক ভাই।

নুরুল আলম আতিকঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।


ছবি কৃতজ্ঞতা: শরীফ খিয়াম আহমেদ ঈয়ন ও পাণ্ডলিপি কারখানা
অনুলিখন: অসীম নন্দন

এ সম্পর্কিত আরও খবর