ঈদের সিনেমায় নতুন প্রাণ ‘শান’

সিনেমা, বিনোদন

কামরুজ্জামান মিলু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 15:17:02

কে কবে সবশেষ বাংলা সিনেমা বড়পর্দায় দেখেছেন? এই হিসেব কষলে দেখা যাবে, অনেকেই বাদ পড়েছেন এই তালিকায়। বাংলাদেশে একটা সময় ছিল ঈদের সিনেমা মানেই ছিল পরিবার, বন্ধুবান্ধবসহ টিকেট কাটার হিড়িক। যুগ যুগ ধরে ঈদ উৎসবে দর্শক নতুন নতুন সিনেমা দেখে খুঁজে পান অন্যরকম আমেজ। মাসের পর মাস চলেছে এক সিনেমা। দর্শকের ভালোবাসায় হয়েছে হিট, সুপারহিট, বাম্পারহিট। অনেক সময় নতুন সিনেমা দেখার জন্য দলবেঁধে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় নতুন সিনেমা দেখতে যাওয়ার উৎসব ছিল চোখের পড়ার মত। সময় করে সিনেমা হলে গিয়ে নিত্য নতুন গল্পের ছবি দেখা বন্ধ হয়েছে দর্শকের অনেক আগেই। তবুও করোনার পর ঈদের সিনেমা নিয়ে হইচই দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর পর। জানামতে, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশজুড়ে ১৬৫টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে চারটি সিনেমা। তার মধ্যে ৩৪টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে ‘শান’।

সিয়াম আহমেদ ও পূজা চেরি অভিনীত সিনেমা ‘শান’। এ সিনেমা প্রদর্শনের সময়ে বেশির ভাগ শো ছিল হাউজফুল। ভালো সাড়া এসেছে দর্শকের কাছ থেকে । যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাসেও চলছে শানের শো। ব্লকবাস্টার সিনেমাসের সহকারী মার্কেটিং ম্যানেজার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ঈদের দিন শানের তিনটি শো ছিল। ঈদের পরদিন থেকে প্রতিদিন চারটি করে শো চলছে। বুধবারের শেষ শোও হাউজফুল ছিল। এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া সব বাংলা ছবিই প্রদর্শন করা হচ্ছে ব্লকবাস্টার সিনেমাসে। তার মধ্যে শান নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ বেশি থাকায় সবচেয়ে বেশি শো দেয়া হয়েছে।

নির্মাতা এম. রাহিম নিজের পরিচালিত প্রথম সিনেমাতেই চমক দেখিয়েছেন । সিয়াম আহমেদ ও পূজা চেরি অভিনীত তৃতীয় সিনেমা 'শান'। পুলিশ অ্যাকশন ঘরানার এই সিনেমাটি ঘিরেও বেশ আগ্রহ দেখা গেছে দর্শকের মাঝে। ইতোমধ্যে সিনেমাটির ট্রেলার থেকে শুরু করে গান সবকিছু বেশ ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। সিয়াম-পূজার রসায়ন থেকে শুরু করে পুলিশের থ্রিলার কাহিনি–সবকিছুতেই ঈদের আমেজ খুঁজে পাচ্ছে দর্শক।

শান সিনেমার শুটিংয়ে যে বাইক ব্যবহার করা হয়েছিল, সেই বাইকে চেপেই নারায়ণগঞ্জে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে সিয়াম ও পূজা চেরির । এই অভিনব কায়দা সিনেমা প্রচারণার জন্য নতুন বার্তা। সেখানকার নিউ মেট্রো ও সিনেস্কোপে শানের শো ছিল হাউজফুল।

মুভিফ্রিক অব বাংলাদেশ এর পেইজে লেখা হয়েছে, কেন এত জনপ্রিয় হলো 'শান'?
'শান' নিয়ে ফেসবুকে কিছু লিখলে একশ্রেণির মানু্ষ যতই প্রবল উৎসাহে 'হাহা' রিঅ্যাক্ট দিক, কিংবা, কমেন্ট সেকশনে, ভুলভাল বানানে যা খুশি লিখে 'শান'কে যতই ডোবানোর চেষ্টা করুক না কেন তারা, এটা মেনে নিতেই হবে- 'শান' সিনেমাকে মানুষ বেশ পছন্দ করেছে৷ মাল্টিপ্লেক্সের ঝা-চকচকে আউটলেট বলি কিংবা কোনো গ্রামের পলেস্তারা-খসা সিনেমাহল... 'শান' সন্তুষ্ট করতে পেরেছে সিংহভাগ দর্শককেই। সেন্সিবল দর্শক যারা আছে, সাধারণ দর্শক যারা আছে, যারা 'বাংলা সিনেমা দেখতে যাচ্ছি' মাইন্ডসেট নিয়েই গিয়েছে হলে, তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যে খুব একটা তারতম্য হয়নি, সেটিও বলাই বাহুল্য৷ এরকম অবস্থায় একটা প্রশ্ন তাই মনে আসেই- কি এমন করলো 'শান', যাতে পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল সিনেমা হওয়া সত্বেও এ সিনেমা শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সবাইকে সন্তুষ্ট করলো?

সে প্রশ্নের উত্তরই এখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করি-প্রথমত, প্রমোশন। বাংলাদেশের সিনেমা-ইন্ডাস্ট্রির খুব কমন একটা প্রাকটিস, এখানের মানুষজন মনে করে- সিনেমা বানানো হয়ে গেলেই দায়িত্ব শেষ। কিন্তু এটা ভাবা পুরোটাই যে বোকামি, তা সচেতন দর্শকমাত্রেই জানেন। চারপাশে এত দেশি-বিদেশি কন্টেন্ট, আপনি মাস্টারপিস বানিয়েও যদি বসে থাকেন, লাভ নেই। আপনাকে প্রকাশ্যে আসতে হবেই। যদিও 'সিনেমা' একটা শিল্প, কিন্তু এই শিল্পের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যও থাকে। তাই, আপনি নিভৃতে থাকলে আখেরে আপনারই ক্ষতি। এবং, এই সত্যটাই খুব ভালোভাবে বুঝে ইমপ্লিমেন্ট করেছে 'শান' টিম। প্রমোশনে এমন সব ইনোভেশন এনেছে, এমন সব জায়গাকে ব্যবহার করা হয়েছে... খুবই ইন্টারেস্টিং। তবে, এরকম ঢাকঢোল পেটানোর একটা চাপও ছিলো। যদি সিনেমা ভালো না হতো- তাহলে গালি যে একটাও মাটিতে পড়তো না, তাও ছিলো নিয়তি। যাই হোক, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। প্রথমে, মেটাফোরিক্যাল পোস্টার আর ইনোভেটিভ প্রমোশনে যে 'শান' বিশাল বড় এক অ্যাডভান্টেজই পেয়েছে, এটাই এ সিনেমার 'এক্সপোজার' পাওয়ার প্রথম স্টেপ।

দ্বিতীয়ত- গল্পের থিম। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, 'শান' এর গল্প দেখলে মাথা ঘুরে যাবে, 'আরে, এভাবে তো ভাবিনি' বলে বোকা হাসি দিতে হবে... এরকম হওয়ার সম্ভাবনা মোটেও নেই৷ কমার্শিয়াল সিনেমায় আমরা যা দেখি, অর্থাৎ, অ্যাকশন, সাসপেন্স, রোমান্স আর ঢিশুম ঢিশুম মারামারির সুস্বাদু শরবত... এখানেও ছিলো তা। সেসব নিয়ে তাই বলছিও না। তবে, এ সিনেমার 'তুরুপের তাস' হিসেবে যে থিম বাছাই করা হয়েছিলো, যে থিমকে রাখা হয়েছিলো ট্রেলার এবং পোস্টারের ফ্রন্টলাইনে, সেই 'হিউম্যান ট্রাফিকিং ও হিউম্যান অরগ্যান স্মাগলিং' থিম ছিলো 'শান' এর অন্যতম প্লাস পয়েন্ট। সন্ত্রাসীয়া ড্রাগ পাচার করছে, সন্ত্রাসীরা নায়কের বাবা-মা'কে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, সন্ত্রাসীরা জঙ্গী-হামলা চালাচ্ছে... এসব নিয়ে সিনেমা তো গন্ডায় গণ্ডায় আছে। কিন্তু, 'মানব অঙ্গ পাচারকারী' চক্রের এই যে দৌরাত্ম্য, যেটা জাতীয় একটা ইস্যুও, এটা নিয়ে কোনোদিন কাজ হয়েছে? হয়নি। এবং সেটাই মূলত এ সিনেমাকে দিয়েছে লাইমলাইটে আসার সুযোগ। মানুষজন এই থিমের সিনেমা আগে দেখেনি, স্বভাবতই- আগ্রহও ছিলো আকাশচুম্বী।

তৃতীয়ত- পরিমিতিবোধ। এ সিনেমার আরেকটা বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেটা সিনেমার পরিমিতিবোধ। এ সিনেমায় রোমান্স আছে, কিন্তু সে রোমান্স খুব মিষ্টি। সে রোমান্সে ক্রিঞ্জ কথাবার্তা নেই। 'ওভার দ্য টপ' ইমোশন নেই। এ সিনেমায় অ্যাকশন আছে। কিন্তু, সেসব খুব স্মার্ট অ্যাকশন। একা নায়ক হয়তো বিশজনকে মারছে, কিন্তু সেটার পেছনেও কনভিন্সিং একটা ব্যাপার আছে। অর্থাৎ, বাড়াবাড়ি লাগছে না। 'কমার্শিয়াল' সিনেমা বলে এই অবিশ্বাস্য মারামারি বেশ উতরেও যাচ্ছে। আবার, যখন ডায়লগ ডেলিভারি হচ্ছে, সেসব ডায়লগ 'লাউড' হলেও বিশ্রি লাগছেনা। চিজি লাইন আছে এখানেও, কিন্তু খুবই দারুণ সহাবস্থানে আছে তা। আবার, এসবের পাশাপাশি- কমেডিও আছে এখানে। কিন্তু সে কমেডিও লাইট। দেখলে বিরক্ত লাগছেনা। এই যে একটা সিনেমায় অনেকগুলো লেয়ার, কিন্তু সবগুলো লেয়ারই পারস্পরিক সহাবস্থানে থাকছে, একটা আরেকটাকে ওভারল্যাপ করছে না...এই বিষয়টি ভালো লেগেছে সবারই। যতটুকু না হলেই না, এবং, যতটুকুর বেশি আর যাওয়া যাবেনা... এই যে বোধ, এটা বুঝে ইমপ্লিমেন্ট করা এ সিনেমার আরেকটা স্ট্রং ট্রিটমেন্ট।

এসব মিলিয়ে অর্থাৎ- প্রমোশন, ইউনিক থিম, গল্পবয়ানে পরিমিতিবোধ... এ তিন ডিপার্টমেন্ট একত্রে ক্লিক করার কারণেই মূলত 'শান' একটা কোয়ালিটি কন্টেন্ট হয়েছে। সবাইকে স্যাটিসফাইড করেছে। যদিও, এর বাইরেও জনপ্রিয়তার আরো দুয়েকটি কারণ থাকলেও থাকতে পারে। তবে, সেসব থাকলেও, এ সিনেমার জনপ্রিয়তার মূখ্য কারণ বলে মনে হয়েছে আমার এই তিনটি বিষয়কেই৷ এবং এ কারণগুলো যদি কোনো বাংলা সিনেমা অনুসরণ করে, তাহলে সে সিনেমা দেখতে দর্শক হলে আসবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।

৮ই মে পরিচালকের পোস্টে দেখা যায়, গোটা ময়মনসিংহ যেন এসে পড়েছিল 'শান' দেখতে। শানের জন্য এতো ভালোবাসা, এতো উন্মাদনা সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। শুধু ময়মনসিংহ না গতকাল হাউজফুল ছিল বাংলাদেশের অধিকাংশ সিনেমা হল। শানের উন্মাদনায় মাতুন আপনারাও। আসুন 'শান' দেখতে আপনার নিকটস্থ সিনেমা হলে। ময়মনসিংহ সিনেমার প্রচারণায় গিয়েছিলেন সিয়াম আহমেদ। ছায়াবানী সিনেমাহলে বাটন ফোনে ফ্রেমবন্দী করেন তার ভক্তরা!

৫ই মে পূজা চেরি তাঁর অফিসিয়াল পেইজে জানিয়ে দেন, মধুমিতা ডিসি হাউজফুল। ইভিনিং শো। সিনেস্কোপ আগামী শনিবার পর্যন্ত ৩ টা শোর টিকিট সেল হয়ে গেছে। যমুনা ব্লকবাস্টার হাউজফুল। সিনেপ্লেক্স হাউজফুল।

অনেকের ধারণা ছিল, সিনেমা যেমনই হোক দর্শক আর ঘর থেকে বেরিয়ে প্রেক্ষাগৃহে যাবে না। কিন্তু ঈদের সিনেমাগুলো প্রমাণ করেছে, সে ধারণা সঠিক নয়। ঈদের সিনেমা দিয়ে জমজমাট সিনেমাপাড়া। আবারও প্রেক্ষাগৃহে ফিরতে শুরু করেছেন সিনেপ্রেমী দর্শক।'পোড়ামন ২', 'দহন' খ্যাত এই নায়িকার অভিনীত ২টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে এবারের ঈদে। একটি এম রাহিম পরিচালিত 'শান', অপরটি এস এ হক অলিক পরিচালিত 'গলুই'। ঈদে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে দুটো সিনেমা মুক্তি পেলো আপনার। অনেকে বলছেন পূজার প্রতিদ্বন্দ্বী এবার পূজাই। এই ব্যাপারটা আপনি কীভাবে নিচ্ছেন? কোনো চাপ অনুভব করছেন কিনা? এই নায়িকার উত্তর, আমি খুব ইতিবাচকভাবে দেখছি । নায়িকা হিসেবে আমার পথচলা মাত্র চার বছরের। বলতে গেলে আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করেছি মাত্র। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে শুরুতেই ঈদের মতো বড় উৎসবে আমার দুটি ভালো সিনেমা মুক্তি পেলো। খুব ভালো লাগছে। কোনো প্রকার চাপ অনুভব করছি না।

ফেসবুক পোস্টে দর্শকদের প্রতি ভালোবাসা জানিয়েছেন সিয়াম আহমেদ। এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, সবখান থেকেই ভালো খবর। এমন রেসপন্স প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। টিম শান সারা দিন চেষ্টা করেছে দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে, যারা এত কষ্ট করে বাংলা সিনেমার দুর্দিনে হলে এসে ছবি দেখছে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে। আপনাদের স্যালুট।

"শান" তার গল্পের কারণেও এগিয়ে থাকবে। গতানুগতিক রোমান্সে আটকে না থেকে বড়সড় কিছু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যার কথা বলেছে শান। চলচ্চিত্রে যেমন প্রেম-ভালোবাসা উঠে আসে,,উল্টো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সমস্যার কথাও তুলে ধরা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি সেই পয়েন্ট থেকে "শান" টিমকে ধন্যবাদ দেয়া যায়। সিনেমাটির কাহিনী লিখেছেন আজাদ খান। তার সঙ্গে যৌথভাবে প্রযোজনা করেছেন এম আতিকুর রহমান। এতে সিয়াম-পূজা ছাড়াও অভিনয় করেছেন তাসকিন, চম্পা, অরুণা বিশ্বাস, হাসান ইমাম, মিশা সওদাগর, নাদের চৌধুরী, ডন, আরমান পারভেজ মুরাদ প্রমুখ।

প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জল ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমার বিষয়ে বলেন, দীর্ঘদিন পর দর্শক আবারও প্রেক্ষাগৃহে আসছেন। এটি বাংলা সিনেমার জন্য ইতিবাচক। ‘গলুই’, ‘শান’, ‘বিদ্রোহী’ তিনটি সিনেমাই ভালো ব্যবসা করছে। এ সিনেমাগুলির মাধ্যমে ব্যবসার ধারা অব্যাহত থাকলে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি খুব শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর