আপনার মুখ কি ভোলা সম্ভব বুলবুল ভাই?

সুরতাল, বিনোদন

ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 08:34:21

চলতি মাসের দুই তারিখে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। এই কয়েক ঘন্টা আগেও যিনি বেঁচে ছিলেন, মুহূর্তের ব্যবধানে তার নামের পাশে ‘প্রয়াত’ শব্দটি বসাতেও হাত কাঁপে। সেই ছবির ক্যাপশনে ছিল, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও ... তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম’।

বুলবুল ভাই, আপনাকে, আপনার মুখকে কি ভোলা সম্ভব? আগে থেকেই কি বুঝতে পেরেছিলেন আপনি, জীবন নামের এই জেলখানায় আপনার সময় ফুরিয়ে আসছে খুব দ্রুত!

আপনার অমর সৃষ্টি ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’ গানের কথাগুলোই কি আপনার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল বুলবুল ভাই? গানের কথায়, গানের সুরে যে ব্যাকুলতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেটাই কি আপনার মনের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলেছিলেন সেদিন! কে জানে! কেউ হয়তো আর জানতেও পারবে না কখনো!

কিন্তু আপনার মুখ ভোলা সম্ভব নয়। কখনোই নয়। ঠিক একইভাবে ভোলা সম্ভব নয় আপনাকে, আপনার অমর কীর্তিকে। সত্তর-আশির দশক থেকে বর্তমান সময়ের এমন কোন জনপ্রিয় গান নেই যার সঙ্গে আপনার নামটি জড়িয়ে নেই।

রক্তে শিহরণ জাগানিয়া অমর গান ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘একাত্তুরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’ থেকে শুরু করে চোখে পানি এনে দেওয়া ‘আম্মাজান আম্মাজান’ কিংবা দারুণ রোম্যান্টিক গান ‘তুমি আমার এমনই একজন’- সবখানেই আপনার সরব উপস্থিতি। সবখানেই আপনি আছেন বুলবুল ভাই।

আপনার রচিত ও সুর দেওয়া প্রতিটি গানের প্রতি ভালোলাগাকে প্রকাশ করতে গেলে দিন পার হয়ে রাতের অন্ধকার নেমে আসবে। তবুও যেন বাকি থেকে যাবে বহু কথা। ‘একতারা লাগে না আমার, দোতারা লাগে না’ গানের মতোই প্রতিটি অসাধারণ গান ও গানের সৃষ্টিতে একজন বুলবুলই যথেষ্ট ছিলেন। আর কোনকিছুর প্রয়োজন ছিল না।

মিষ্টভাষী আপনার মুখের কথাগুলোও ছিল আপনার সৃষ্ট গান ও সুরের মতো শ্রুতিমধুর। এখনও মনে পড়ে ক্লোজআপ ওয়ানের দিনগুলো। প্রতিযোগীদের সঙ্গে কতটা মমতা, দরদমাখা কণ্ঠে কথা বলতেন আপনি। কেউ ভুল করলেও ধমক দেওয়ার পরিবর্তে কতটা স্নেহ নিয়ে ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন, শেখানোর চেষ্টা করতেন। এমন করে আর কেউ কি পারে মততা আর স্নেহ নিয়ে ভুল শুধরে দিতে? বুলবুল ভাই, আপনাকে আসলেও ভোলা সম্ভব নয়, কখনোই নয়।

আপনি এমন একজন মানুষ, যিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে পার্থিব সকল কিছুর মায়া, ভালোলাগা, ভালোবাসাকে ত্যাগ করে দেশের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। অস্ত্র হাতে নেমে গিয়েছিলেন যুদ্ধের ময়দানে। ১৫ বছরের একজন কিশোরের চোখে রঙিন স্বপ্নের বদলে ছিল দেশকে মুক্ত করার উন্মাদনা। বুলবুল ভাই, এমন কিশোর আপনি ছাড়া আর কে হতে পারে। এই কিশোরকে কেউ কীভাবে ভুলতে পারে বুলবুল ভাই!

২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধীর ট্রাইবুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল আপনাকে সরকারের নির্দেশে। ১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানার গণহত্যার ইতিহাস সম্পর্কে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে হয়েছিল আপনাকে। কারণ সেই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া পাঁচজনের একজন ছিলেন আপনি।

এই সাক্ষ্যের মাশুল হিসেবে হারাতে হয়েছে আপনার প্রিয় ও নিরপরাধ ছোট ভাই মিরাজকে। হারাতে হয়েছে নিজের স্বাধীনতাকে। স্বেচ্ছায় কারাবাসের মতো টানা ছয় বছরের বেশি সময় বাড়ির ভেতর থাকতে হয়েছে নিরাপত্তার খাতিরে।

এই গৃহবন্দী জীবন আপনাকে অসুস্থ করে তুললো। দেখা দিলো হৃদরোগ। একসাথে আটটি ব্লক ধরা পড়লো আপনার হার্টে।

গত বছরের মে তে নিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়েছিলেন, একটি ঘরে ছয় বছর যাবত গৃহবন্দী থাকার ফলে এতোটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যেকোন সময় হার্টের বাইপাস সার্জারি করানোর জন্য প্রস্তুত আছেন আপনি। আরও বলেছিলেন, ‘শুধু অপারেশনের আগে ১০ সেকেন্ডের জন্য বুকের মাঝে বাংলাদেশের পতাকা আর কোরআন শরিফ রাখতে চাই’।

বুলবুল ভাই, কীভাবে ভোলা যায় আপনাকে? একজন মানুষকে কি আদৌ ভোলা সম্ভব? জীবনের এমন চূড়ান্ত সময়েও দেশের প্রতি, নিজের বিশ্বাসের প্রতি এমন অবিচল ভালোবাসাকে যিনি আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিলেন নিজের হৃদয়ের খুব কাছে, তিনি এক আপনি ছাড়া আর কে হতে পারে বুলবুল ভাই!

মৃত্যুর চাইতে বড় সত্য আর কিছু নেই। অথচ সত্যকে মানতে আমাদের আজ বড় কষ্ট। এই কষ্টটাকে মাথায় পেতে নিয়েই বিদায় দিতে হবে আপনাকে। এটা যতটা সত্য, ঠিক ততটাই সত্য আপনাকে কখনোই ভোলা সম্ভব নয়, কখনোই না!

এ সম্পর্কিত আরও খবর