দেশের অন্যতম সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবী বরাবরই গভীর কথা ও মেলোডিয়াস সুরের গান গেয়ে আসছেন। শ্রোতাদের রুচির দোহাই দিয়ে কেউ তাকে হালকা কথা ও দুর্বল সুরের গান করতে বলে তিনি কখনোই তাতে রাজী হননি। এবার এই প্রসঙ্গে ধরেই ফাহমিদা নবীর এক ফেসবুক পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোচিত হচ্ছে। গত ২১ জুন বিশ্ব সঙ্গীত দিবস উপলক্ষে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্টটি করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিল্পী।
বিষয়টি নিয়ে ফাহমিদা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কেউ ভাববেন না যে লেখাটি আমার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার কিংবা কোন ক্ষোভ থেকে লেখা! নির্দিষ্ট কোন শিল্পী বা কোন গান নিয়েও লিখিনি। আমি লিখেছি আমাদের সামগ্রিক মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে। বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে আমার মনে হলো- কি দিতে পারি শ্রোতাদের। আমার তো কোন ব্যক্তিগত অর্জন নেই, তারপরও আমি শিল্পী মাহমুদুন্নবীর সন্তান। গানকে আঁকড়ে ধরে আছি অনেক বছর। তাই কোথাও গেলে আমাকে নানা তীর্যক প্রশ্নের মুখে পড়তেই হয়। সবাই যখন জিজ্ঞেস করেন, আপনাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা এমন কেন? ভালো গান কেন হয় না? তখন কিন্তু উত্তরটা আমাকেই দিতে হয়। সেই কষ্ট ও সামগ্রিক উপলব্ধি থেকেই লেখাটি লিখেছি।’
ফাহমিদা নবী তার সেই পোস্টে লিখেছেন, ‘তবে কি সঙ্গীত দিবস ব্যর্থ! আমাদের অস্থির মানসিকতার করাঘাতে? ভাবলাম বর্তমানে অনেক সিনেমা তৈরী হচ্ছে, কিছু সো কল্ড ভিউ গানের পাশাপাশি শোনার মতো গানও তৈরী হবে বোধ হয়। তা আসলে হবার নয়। রুচিহীনতা একটি বিশাল কারন ভালো গান না তৈরী হবার ক্ষেত্রে। ভালো গানের জন্য অস্থিরতার দৌঁড় নয়, ভালোবাসা দরকার, সেটাই তো নাই! তবে বলে রাখি, রুচিহীন গান বেশিদিন ধোপে টেকে না। দেখছি সেই ছোটবেলা থেকে। শ্রোতারা এতো গাঁধা না। যারা গান শোনে তারা ভালো মেলোডিয়াস গানই খোঁজে, মনেও রাখে। শ্রোতাকে দোষী করে কোন লাভ হবে না। যারা মেধার অপচয় করছে, তারাই বড় বিপদে পড়বে। রুচির হাহাকারে, প্রতিযোগীতাটা মারপিট সিনেমা সিনের মতো হয়ে গ্যাছে। কিন্তু সত্যিকার প্রতিযোগীতায় মেধার অ্যাকশন দরকার। সেটাই নাই! কেও সহজ করে হাসে না, প্রয়োজনে হাসে বলেই এই দুর্ভিক্ষ!’
ফাহমিদা আরও লিখেছেন, ‘বর্তমানে সমাজে তো কোন সংস্কৃতি চর্চা, ভালোবাসা, সম্মান কিচ্ছু নাই। আছে উন্মদনা, অস্থিরতা আর কে কাকে পিছনে ফেলে দৌঁড় দিবে সেই স্বার্থপর চিন্তা! কোন সরল হাসি নাই। কর্পোরেট সিন্ডিকেট চর্চা যেখানে প্রবল, সেখানে আর যাই হোক সঙ্গীত হবে না। সঙ্গীতের ধারা শান্ত এবং রাজকীয়, তা সাজানোর জন্য ধীরতা দরকার। উটকো কথা আর সুরের চটপটিতে গান এখন পালিয়ে বাচঁতে চায়! সঙ্গীত সবার জন্য না। ইদানিং বিষয়টা আরো বুঝতে পারছি। কারণ যাহা মনে লয় উন্মাদনা ইন্ডাস্টিকে দিন দিন অশিক্ষিত করে তুলেছে। একটা দেশের রুচিশীলতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? রুচির দুর্ভিক্ষে সত্যিই আমরা তলিয়ে গেছি, আফসোস! কিছু মানুষ হয়তো এখনো পরিশোধিত ফিল্টারে নিজেকে নিরব সাধনায় রাখছে। তারাই আশা, আশা ছাড়া অভিমান কি বাঁচে? অভিমান জরুরী, তা না হলে জ্ঞান আর অশিক্ষার মাঝে পার্থক্য বোঝা যাবে কি করে?’
তাই এই স্ট্যাটাসে অনেকেই একমত পোষন করেছেন। ফাহমিদা নবী বার্তা২৪.কমকে আরও বলেন, ‘আমার বিশ্বাস গানের জগতের এই অস্থিরতা একদিন থেমে যাবে। এরমধ্যে যে গানগুলো ভালো হবে সেগুলোই বেঁচে থাকবে।’
বর্তমানের সিনেমার গান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিনেমার মানুষরা যেমন একে অপরকে টেনে নিচে নামানোর প্রতিযোগীতায় মেতেছে, তেমনি তাদের গানগুলোও যেন অস্থির। কিন্তু সিনেমার গান কিন্তু এমন হওয়া উচিত নয়। সিনেমার প্রয়োজনে নানা ধরনের গান থাকবে, মেলোডিয়াস গান সিনেমার প্রাণ। একটি চটুল কথার গান থাকতেই পারে, কিন্তু সব গান এমন হলে মুশকিল। হয়তো অল্প দিনের জন্য দর্শক শ্রোতারা গানটি নিয়ে মাতামাতি করবে কিন্তু কিছুদিন পর তা আর মনেই আসবে না। সেটি কিন্তু সিনেমার জন্য ভালো কিছু নয়। একটি ভালো গান একটি সিনেমাকেও বহু বছর বাঁচিয়ে রাখে। সে প্রমাণ তো আমরা পুরনো দিনের সিনেমার গানের মাধ্যমে এখনো পাচ্ছি। তাই সবাইকে স্থির হয়ে সময় নিয়ে যত্ন সহকারে গান করার অনুরোধ করছি।’
এদিকে, ফাহমিদা নবী তার পরবর্তী আমেরিকা ট্যুরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী মাসের শুরুর দিকেই তিনি সেখানকার ডেনভার কলরাডোতে চিকিৎসকদের আয়োজনে একটি কনসার্টে গাইবেন।