দেশের তুমুল জনপ্রিয় লেখক সাদাত হোসাইন। বিদেশেও রয়েছে তার লেখার অসংখ্য ভক্ত। সাদাত শোবিজের কাজের সঙ্গেও যুক্ত। প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন কয়েক বছর আগেই। এখন দ্বিতীয় সিনেমা নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সমসাময়িক বিষয়ে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসিদ রণ
বর্তমানে কী লিখছেন?
এই মুহূর্তে একটি বিশেষ বই লিখছি। কারণ এটি ভ্রমণকাহিনী, এবারই প্রথম ভ্রমণবিষয়ক বই লিখছি। সম্প্রতি ইউরোপ ট্যুরে গিয়েছিলাম। ইউরোপের ৮-৯টি দেশ ঘুরেছি যতোটুকু পেরেছি। দেশে আসার পর অন্যপ্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম (হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ বইয়ের প্রকাশক) আমাকে বললেন, এবারের ইউরোপ ট্যুরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি ভ্রমনকাহিনী লিখতে। আইডিয়াটা আমারও খুব ভালো লাগলো, তাই রাজী হয়েছি। বইটির নাম দিয়েছি ‘যেতে যেতে তোমাকে কুড়াই’। এই বইটি আসছে জুলাইয়ে প্রকাশিত হওয়ার কথা।
ভ্রমণকাহিনী লেখা আমার জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা। কাজটি আমি করতে চেয়েছি কারণ বাংলা সাহিত্যে খুব সফল বেশকিছু ভ্রমণকাহিনী রয়েছে, যা পড়ে আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণীত হয়েছি। যার মধ্যে অবশ্যই সৈয়দ মুজতবা আলীর বইগুলোর কথা বলতে হয়। এছাড়া রয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের খুব বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’। আরেকটি বই আছে ‘পায়ের তলায় শর্ষে’।
ইউরোপ ট্যুরের উল্লেখযোগ্য কর্মযজ্ঞ কি ছিল?
গিয়েছিলাম মূলত ইউরোপের চারটি দেশের চারটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। দেশে এবং দেশের বাইরে আমার লেখা যারা পছন্দ করেন তারা আমার জীবন সম্পর্কেও জানতে চান। কিভাবে বেড়ে উঠেছি, কি কি স্ট্রাগল ছিল কিংবা লেখালেখির অনুপ্রেরণা কি এসব নিয়ে তাদের আগ্রহ রয়েছে। তাদের জন্য ‘সাদাত হোসাইনের জীবনের গল্প, গল্পের জীবন’ নামের একটি সেশন তৈরী করেছি। এরইমধ্যে অষ্ট্রেলিয়া, দুবাই, ভারতসহ কয়েকটি দেশের আমন্ত্রণে আমার জীবন ও কর্ম নিয়ে সেই সেশনটি করা হয়েছে। এবার ইউরোপের দুটি দেশ থেকে একই সেশনের জন্য আমন্ত্রণ পাই। প্রথম সেশনটি ছিলো বেলজিয়ামের ব্রাসেলস-এ বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে। এরপর জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটের বাঙালিরা আয়োজন করে আরেকটি সেশন।
এছাড়া ফ্রান্সের প্যারিসের প্রবাসী বাঙালিরা আমাকে একটি সম্মাননা প্রদাণ করেছে। এই প্রোগ্রামগুলোর ফাঁকে ফাঁকে চেষ্টা করেছি অন্যদেশের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরতে। সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলাম, এরপর ইতালির মিলান ও ভেনিস, ফিরে আসার টিকিট ছিল রোম থেকে। সেখানকার বাংলাদেশি সাংবাদিকদের অ্যাসোসিয়েশন থেকেও আমাকে আরেকটি সম্মাননা দিয়েছে।
২০২৪ সালটা কিভাবে কাটানোর পরিকল্পনা করেছেন?
লেখালেখিই তো আমার প্রধান কাজ, যেহেতু লেখাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। তাই লেখালেখি নিয়েই সারা বছরের ব্যস্ততা। সাধারনত প্রতি বছর দুটো উপন্যাস লিখি ‘অন্যপ্রকাশ’ ও ‘অন্যধারা’ প্রকাশনা সংস্থা দুটির জন্য। এক বছরে আসলে এর বেশি উপন্যাস লেখা কষ্টকর। কারণ এক একটি উপন্যাসে কম করে হলেও তিন-চার মাস সময় লাগে আমার। এছাড়া আরও কিছু কাজ করে থাকি, যেমন বিভিন্ন দেশের বইমেলা ও সেশনে অংশ নেওয়া। এসবেও বেশ ভালোই সময় চলে যায়। আগামী বছরের একুশে বইমেলার জন্যও দুটি উপন্যাস লিখছি। একটি হলো ২০২৩ সালে প্রকাশিত আমার ‘শঙ্খচূড়’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড। এটিও অন্যপ্রকাশ থেকেই আসবে। এরপর অন্যধারার জন্য লিখবো আরেকটি নতুন উপন্যাস।
এর ফাঁকে অন্যকিছু কাজও করার চেষ্টা করি, যদিও সময় খুব কম পাই। সাম্প্রতিক সময়ে নির্মাতা শিহাব শাহীনের বেশকটি ফিকশনে আমার লেখা গান ছিলো। এরমধ্যে রয়েছে ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ ওয়েব ফিল্মের ‘মেঘের মেয়ে মেঘবালিকা’ গানটি, ‘মায়াশালিক’-এ তাহসানের গাওয়া ‘কতো কথা ছিলো’ গানটি। ‘তালাশ’ সিনেমার দুটি গান আমার লেখা। হাসিবুর রেজা কল্লোলের ‘কবি’ সিনেমা আসছে শরিফুল রাজ আর ইধিকা পাল অভিনীত। তাতেও আমার একটি গান থাকবে। এই গানটির মাধ্যমে বাংলাদেশের সিনেমার কোনো গান করবেন অনুপম রায়। ‘সিন্ডিকেট’ ওয়েব সিরিজে আমার কবিতা ‘কাজল চোখের মেয়ে’ দারুণ সাড়া ফেলে আফরান নিশোর কণ্ঠে।
সঙ্গীতশিল্পী আসিফকে নিয়ে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গহীনের গান (মিউজিক্যাল ফিল্ম)’ নির্মাণ করেছিলেন কয়েক বছর আগে। এরপর আর নির্মাণে দেখা গেলো না কেন?
ভিজ্যুয়াল মিডিয়াম নিয়ে তো আমার প্রচণ্ড আগ্রহ। শুধু ভিজ্যুয়াল বললে ভুল হবে, আমি আসলে গল্প বলতে চাই। যে যে মাধ্যমে গল্প বলার দক্ষতা আমার আছে সব মাধ্যমেই বলতে চাই। হোক সেটা সাহিত্য, গান, সিনেমা কিংবা ফটোগ্রাফি । আমার প্রথম লেখা বই ‘গল্পছবি’ ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়, সেটি ছিল ফটোগ্রাফিবিষয়ক।
সেই জায়গা থেকেই কিন্তু সিনেমা নির্মাণে হাত দেওয়া। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দিয়ে শুরু করেছিলাম, আমার দুটি ছোট ছবিই (‘বোধ’ ও ‘দ্য সুজ’) পুরস্কৃত হয়। এরপর ‘গহীনের গান’ করি। তবে পরের ছবিটি করার জন্য যে সময়টা দরকার ছিল, তা পাচ্ছিলাম না। কারণ আমার মূল পেশা লেখালেখি। সেটির জন্য প্রচুর সময় ও মনোসংযোগ দরকার। তবে এরমধ্যেও সিনেমা নিয়ে একধরনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি। লেটস সি, সামনে কী হয়। আপাতত এরবেশি কিছু বলতে চাইছি না। আসলে বছরজুড়ে এতো ব্যস্ত থাকতে হয় যে সব দিক কুলিয়ে উঠতে পারি না। এই যে হ্ঠাৎ করেই আবার এখন ভ্রমণ কাহিনীটি শুরু করতে হলো। যার জন্য পূর্বনির্ধারিত অন্য একটি কাজ পেছাতে হল। তবে এখন পরিকল্পনা আছে বইমেলার উপন্যাসগুলো লেখা শেষে ডিসেম্বর বা সামনের জানুয়ারির দিকে কাজটি ধরবো। দ্যাট উইল বি সামথিং ভেরি ইন্টারেস্টিং!
আন্তর্জাতিক বাবা দিবসে আপনার বাবা ‘গর্বিত বাবা সম্মাননা’ পেয়েছেন। সেই অনুভূতি কেমন ছিল?
এটা আসলেই স্পেশ্যাল। নিজের কাজের মাধ্যমে বাবা মাকে গর্বিত করার মতো সফলতা আর কী থাকতে পারে? তবে আমাদের মতো গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় হওয়া একটি সন্তানের পক্ষে লেখালেখি করে ক্যারিয়ার তৈরি করা আবার তাতে বাবা মাকে গর্বিত করা খুব কঠিন। কারণ লেখালেখি করে ভালোভাবে জীবন ধারণ করার মতো অবস্থা এখনো আমাদের এখানে সেভাবে তৈরি হয়নি। তাই আমার বাবা মাও চাইতেন আমি এমন কোন চাকরি করি যাতে ভবিষ্যত সুনিশ্চিত হয়। এমন না যে আমিও ছোটবেলা থেকে লেখকই হতে চেয়েছি।
আমাকে আসলে অনেক স্ট্রাগল করে এই পর্যন্ত আসতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর পরই বাবা অসুস্থ হয়ে শয্যাসায়ী হয়ে পড়েন। পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়ে। তখন আমার কাছে বাবা মায়ের একটাই চাওয়া ছিলো, যে কোন সৎ উপায়ে যেন পরিবারকে চালিয়ে নিতে পারি। তখন আমি নিজের মধ্যে লেখালেখির প্রতিভার বিষয়টি আবিষ্কার করি। এবং এদিক থেকে আমি খুব ভাগ্যবান যে অল্প সময়ের মধ্যেই আমার লেখা (প্রথম উপন্যাস ‘আরশিনগর’ই দারুণ জনপ্রিয়তা পায়) প্রচুর সংখ্যক মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই আসলে লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা চিন্তা করি। ততোদিনে দেশে ও দেশের বাইরে আমাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ ও সম্মান দেখে বাবা মাও খুব সম্মানিত বোধ করতে লাগলেন।
কলকাতা বইমেলায় আপনাকে নিয়ে দারুণ উন্মাদনা দেখা যায়। আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের চেয়ে সেখানকার পাঠক আপনাকে বেশি পছন্দ করে?
একেবারেই তা মনে করি না। আমার কাছে মনে হয় যেখানে বাঙালি পাঠক আছেন সব খানেই আমি সমান ভালোবাসা পাই। এই ভালোবাসার কোন সীমানা নেই। বিশেষ করে এই সোশ্যাল মিডিয়ায় যুগে সবাই যখন রিলস দেখতে ব্যস্ত সেই সময়ে এসেও এতো মানুষ আমার লেখা পড়ছে এটা ভাবতেই অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে। তাই পাঠকের ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমি কোন তুলনা করতে চাইনা। তাছাড়া কলকাতা বইমেলাতে আমি যাই প্রতি বছর হয়তো তিন চারদিনের জন্য। অল্প সময়ের জন্য আমাকে তারা পায় বলে সব উন্মাদনা একইসঙ্গে প্রকাশ পায়। আর বাংলাদেশের পাঠক আমাকে মাঝে মধ্যেই কাছে পেয়ে যান, বইমেলাতে দেখা যায় ১৫ দিন যাচ্ছি। তাই হয়তো উন্মাদনা তাদের মতো অতো প্রবলভাবে দেখা যায় না।