আজ দুই বাংলার নন্দিত অভিনেত্রী জয়া আহসানের জন্মদিন। সারাটাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধু জয়ার ছবিই ঘুরছে। ভক্ত থেকে সহকর্মী, সাংবাদিক - সবাই তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছায় সিক্ত করছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা সিনেমা দিয়ে খ্যাতি পাওয়া এই তারকাকে নিয়ে লিখেছেন মেধাবী গীতিকার, সুরকার, কম্পোজার, উপস্থাপক ও সাংবাদিক তানভীর তারেক
জয়া’কে আমি ফিলসফার হিসেবে মানি।
আমরা হরহামেশাই বলি- শিল্পীদের বিনয়ী হতে হয়।
এটা খুবই ভুল তত্ত্ব।
শুধু শিল্পী কেন? মানুষ মাত্রই বিনয়বচন, বিনয়বতার তার ভেতরে ধারণ করা খুব প্রয়োজন।
প্রশ্ন হল- আমরা এখন অনেকেই খুব বিনয়ী হবার অভিনয় করি। কিন্তু মনে মনে একেকটা খাড়া ইবলিশ!
যাই হোক, মানুষ জয়ার ভেতরে ভান কম। সে সরল। সাবলীল। সহজ। ওর সাথে আমার পরিচয়ের বয়স দেড় যুগের বেশি হয়ে গেল।
জয়া আহসানের অভিনয়ের জার্নিকে কেউ কেউ ঈর্ষা করে। কিন্তু মুশকিল হল, ওর স্ট্রাগলকে তারা আবার মেপে দেখতে চায় না। চাইলে এদেশে আরো এমন শিল্পী তৈরি হতো।
জয়া একটা দারুণ কথা বলে, ‘আমি দৌড়াতে চাই না। দৌড়ালে পথ দ্রুত শেষ হয়ে যায়।’
জয়া’র সাথে আমার একাধিকবার নানান বিষয়ে অন ক্যামেরা/ অফ ক্যামেরা আড্ডা হয়েছে। এত বড় শিল্পী- তাই এভাবে বলা ভাল যে, আমি তার সাথে আড্ডার সুযোগ পেয়েছি বা সে সেই সুযোগটা আমাকে দিয়েছে।
এক আড্ডায় জয়া বলেছিল, ‘তানভীর ভাই , আমি হাঁসের মতো। সারাদিন কাঁদা, পোকা মাকড়ের ভেতরে হাঁটি, ডুবি ভাসি। আবার ডাঙায় এলেই একবারে ঝেড়ে সব ফেলে দিই। কিছু মনে রেখে চলি না।’
কথাটা যখন ওর বাসায় ধারণ করি তখন বুঝিনি, পরে এডিটর যখন এডিট করছে তখন বারবার দেখি! কিভাবে বললো এমন কথা!
জয়া বাংলা ছবির যে পর্যায়ে হাঁটছে তার এই শিল্পযাত্রা সুচিত্রা সেনের পরে কেউ এমন একাই এ পথে এতোটা দূর হাটেনি। এটা আমি অন রেকর্ড একদিন বলেছিলাম কোনো এক অনুষ্ঠানে। সে অনুষ্ঠানে জয়া ছিল না। এক নির্মাতার সাথে আড্ডায় বলেছিলাম।
ঐ ক্লিপ দেখে শীর্ষস্থানীয় এক নায়িকা আমাকে ফোন দিয়ে নানান আদেশ-উপদেশ, বেসুরো ধমক! সিনেমা নিয়ে আপনার অনেক জ্ঞান আছে আগে জানতাম। কিন্তু কী সব মূর্খের মতো কথা বলেন আজকাল। জয়া কেন ? ও অভিনয় জানে নাকি! আপনার মাথা গ্যাছে নাকি। এই বলে- তিনি নিজে কী কী অর্জন করেছেন, সেই গল্প আমাকে বলা শুরু করলেন।
তারপর থেকে আমি অফিশিয়ালি জয়া আহসানকে বাংলাদেশের লেডি সুপারস্টার হিসেবে সম্বোধন করি।
তার মাস কয়েক পরে কোনো এক অনুষ্ঠানে জয়া আর সেই শীর্ষ নায়িকা একসাথে কোনো এক ঘটনাচক্রে। সেখানে পারলে জয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় সে! বলতে থাকে- তোমাকে আমার কী যে ভাললাগে, কেমন করে করো এমন দারুণ অভিনয়!
আগে এসব দৃশ্যে অবাক হতাম। টাফনিল খেয়ে টেয়ে মাথা ঠিক রাখতে হত। এখন আর অবাক হই না। অভ্যেস হয়ে গেছে।
আমরা অনেকটা এরকমই যে, আপনি আমার নীচের অবস্থানে যতদিন আছেন বা থাকবেন ততদিন আপনাকে খুব প্রশংসা করে যাবো। যেই আপনি আমাকে ছাড়িয়ে যাবেন তখনই ছেলেটা/মেয়েটা খুব খারাপ, দিনকে দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আমরা নিজেকে ছাড়িয়ে যাক এটা কখনও নিতে পারি না।
সমস্যা হলো - জয়া আহসান অনেক আগেই এখনকার সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাই এখন তার ঐ হাঁস হয়ে উঠা ছাড়া উপায়ও নাই। আবার অহংকারও তাকে মাটি থেকে আড়াল করেনি কখনও।
আমরা এই সোস্যাল মিডিয়ার জমানায় অদ্ভুত এক কামড়া-কামড়ি কালচারে বাস করছি। কারণ আমাদের অনেকের হাতেই কাজ কম, ক্ষুধা বেশি। তাই আজাগা কুজায়গায় কামড়িয়ে চলেছি।
এটা হয়ত সময়ের দোষ।
বাংলা নাটকের জয়া আহসান থেকে ঢাকাই ফিল্মের জয়া আহসান অত:পর কলকাতার আবর্তের জয়া’র যে জয় যাত্রা- সর্বাধিক ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তি, সর্বাধিক ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তি।
তার এই জার্নিকে আপনি প্রশংসা না-ই করে থাকতে পারবেন। কিন্তু অস্বীকার করতে পারবেন না।
আমরা এখন শিল্পীদের কেউ কেউ একটা-দুইটা হিট হলেই গণমাধ্যমের সাথে আড়াল থাকার খুব চেষ্টা করি। পা অনেকটা মাটি থেকে উপরে রেখে হাঁটার অভ্যেস করি। এতে সে যে ক্রমেই নিজেকে হারিয়ে ফেলে তা বুঝে উঠতে পারে না। গণমাধ্যমকে ফেস করা আর ঠিকঠাকভাবে ফেস করার ভেতরে অনেক পার্থক্য। যা জয়া খুব সুন্দর করে মেনটেইন করে।
জানেন তো! শিল্পীকে সফল না স্বার্থক হতে হয়। কারণ জীবনে একটা কাজে সফল হবেন আবার পরের কাজে ব্যর্থ, তার পরে হয়ত অ্যাভারেজ।
জয়া আমাদের দেশের এক স্বার্থক শিল্পী। একটা মানুষ পুরোপুরি সহী হতে পারে না। জয়াও না। তবে নিজের কথা, নিজের অর্জনের কথা যে মানুষটি বিভিন্ন পাবলিক ডোমেইনে নিজ মুখে বলা শুরু করবে, ভাববেন- তখন থেকেই সে তার নিজেকে হারিয়ে ফেলা শুরু করেছে। জয়া তার প্রত্যেকটা ইন্টারভিউতে আত্মসমালোচনায় থাকেন। এখানেই মেয়েটা ব্যতিক্রম। অদ্ভুত। অসাধারণ।
শুভ জন্মদিন দ্য লেডি সুপারস্টার ‘জয়া আহসান’। আপনি এরমই থাইকেন। আপনাকে ভালবাসা।