ফারুকের জন্মদিনে সোহেল রানা, ‘সে প্রকৃত অর্থেই চলচ্চিত্রের মানুষ’

ঢালিউড, বিনোদন

মাসিদ রণ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-08-18 14:15:56

গত বছর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলাদেশের কিংবদন্তি চিত্রনায়ক ফারুক। ঢালিউডে তার পরিচয় ছিল ‘মিয়াভাই’। শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় এই নামে সম্বোধন করতেন সবাই। আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান। আজ (১৮ আগস্ট) এ অভিনেতার জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের এই দিনে মানিকগঞ্জের ঘিওরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বেঁচে থাকলে ৭৭ বছরে পা রাখতেন তিনি। জন্মদিনে এই প্রখ্যাত তারকাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তার সহশিল্পী ও এ দেশের সিনেমার আরেক প্রখ্যাত নায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা। কথা বলেছেন মাসিদ রণ

৫০ বছরের বেশি সময়ের পরিচিত আমরা। বন্ধু বলি, সহকর্মী বলি, ছোট ভাই, বড় ভাই বলি সব ধরনের সম্পর্কই তার সঙ্গে আমার ছিল। সে সব সময় বড় ভাই হিসেবে আমাকে সম্মান করেছে। আমি তাকে পছন্দ করতাম, নয়তো একই পার্টিতে রাজনীতি করা হতো না। তার সঙ্গে আমার কখনোই মনোমালিন্য হয়নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে আমাকে সম্মান করেছে। আমি তাকে স্নেহের চোখে দেখেছি।

১৯৬৮-৬৯-এর কথা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ছাত্র, তখন ফারুক জগন্নাথ কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়। তখন থেকে দুজনেই ছাত্রলীগ করতাম, ফলে পরিচয় হতে বেশি সময় লাগেনি। যেহেতু আমি বয়সে বড়, কেন্দ্রীয় নেতা ছিলাম আর ও কলেজের রাজনীতি করে, তাই বন্ধুত্ব থাকলেও ছোট ভাই বড় ভাইয়ের একটা সূক্ষ্ম দেয়াল ছিল সম্পর্কে। পরে যখন আমরা চলচ্চিত্র জগতে এলাম, সেই সম্পর্কটা বজায় রেখেই চলেছি।

কিংবদন্তি চিত্রনায়ক ফারুক

আমরা অবশ্য একসঙ্গে বেশি ছবিতে কাজ করিনি। একটা না দুটো ছবিতে কাজ হয়েছে। চলচ্চিত্র জগতে আসার আগে তার নাম ছিল দুলু। সেই নামটিই ছিল আমার প্রিয় বা পরিচিতি। সে বয়সে আমার চেয়ে একটু ছোট হলেও সিনেমা জগতে কিন্তু সে আমার সিনিয়র। আমি আসার আগেই সে প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’ করে ফেলেছে। তখন সেটা খেয়াল করিনি। পরে যখন একই অঙ্গনে কাজ করতে আসলাম, দেখি সবাই তাকে ফারুক নামে ডাকছে। তাই আমিও তাকে ফারুক নামেই ডাকা শুরু করলাম। আর সে আমাকে কখনো কখনো পারভেজ ডাকত, কখনো বড় ভাই বলে ডাকত। এটা হলো তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক।

ব্যক্তি হিসেবে সে ছিল সংগ্রামী এবং জেদি। এগুলো তার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তারা সবাই জানেন। সে একসময় শিল্পী সমিতির প্রেসিডেন্টও ছিল। আমাদের সবাইকে নিয়েই সে তখন অনেক ধরনের মুভমেন্ট করেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিটা সে আজীবনই করে গেছে। শেষ জীবনে সে সংসদ সদস্যও হয়েছে। তার জন্য আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম। কারণ সে এটা ডিজার্ভ করত। সে রাজনীতিতে অনেক সময়, মেধা ও শ্রম দিয়েছিল।

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি গড়ে তুলেছিলেন তারা

আর অভিনয়জীবনের কথা বললে, একজন শিল্পী হিসেবে আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। সে প্রকৃত অর্থেই একজন চলচ্চিত্রের মানুষ এবং শিল্পী হয়ে উঠতে পেরেছিল। তাকে স্বাভাবিকভাবেই বলা যেতে পারে, সে একজন ‘ভালো অভিনেতা’। প্রত্যেক ভালো অভিনেতাই একটা পর্যায়ে নিজের একটা স্বকীয়তা তৈরি করতে সক্ষম হয়। যেটা ফারুকও পেরেছিল। গ্রাম বাংলার প্রতিবাদী যুবকের যে চরিত্র তাতে সে আনপেরালাল হয়ে উঠেছিল। তার মৃত্যুতে এই জায়গায় যে অভাবটা তৈরি হয়েঠে, সেটা পূরণ করার মতো এখন তো কোনো অভিনেতাকে আমি দেখছিই না, আগামী ২০-৩০ বছরেও কেউ তা পূরণ করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।

একফ্রেমে ঢালিউডের ৫ শীর্ষ নায়ক- সোহেল রানা, উজ্জ্বল, রাজ্জাক, ফারুক ও আলমগীর

অনেকে আমার এ ব্যাখ্যাটিকে ভুল বুঝে থাকেন। তারা ভাবেন, আমি ফারুককে শুধু গ্রাম বাংলার চরিত্রের জন্যই পারফেক্ট বলে মনে করি। বিষয়টা তা নয়। আমি তাকে আগেই বলেছি, সে একজন ভালো অভিনেতা। নানা ধরনের ছবি সে করেছে এবং বিভিন্ন ধরনের ছবিতে সে ভালো অভিনয় করেছে। কিন্তু লাঠিয়াল, সুজন সখী কিংবা সারেং বৌ’য়ে তার যে অভিনয়, অর্থাৎ গ্রামীণ পটভূমিকায় তার যে পারদর্শিতা, সেটির ধারে-কাছেও কেউ নেই। একটু উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে। বলিউডের দিলীপ কুমার বা অমিতাভ বচ্চন সব ধরনের ছবিতেই তো দারুণ কাজ করেছেন। কিন্তু একজনকে ‘ট্রাজেডি কিং’ আরেকজনকে ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ কেন বলা হয়? কারণ এ ধরনের চরিত্রে তাদের জুড়ি মেলে না। ফারুকের বেলায়ও আমি সেটিই বলে আসছি বরাবরই।

গ্রামীণ পটভূমির ‘সুজন সখি’ ছবিতে ববিতা ও ফারুক

আজকাল সবাই নিজেকে শিল্পী দাবি করেন। কিন্তু আমি মনে করি যিনি সময়কে ছাপিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নেয়, তিনিই প্রকৃত শিল্পী। ফারুক সেই শিল্পীর একজন। ৫০ বছরের এই হৃদ্যতা কীভাবে ভুলে যাব? দর্শকও তার কাজ অনেক বছর মনে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

পরিশেষে বলব, ফারুক মানুষ হিসেবে খুবই ভালো ছিল। সে ভনিতা পছন্দ করত না। যা বিশ্বাস করত, সেটি মুখের ওপরেই বলে দিত। কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য সে এসব বলত না। তারপরও যদি তার কথা বা কর্মে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, তাকে নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। ও ইচ্ছাকৃতভাবে কারও কোনো ক্ষতিও করতে চায়নি। অযাচিতভাবে যদি তার পক্ষ থেকে কোনো ভুল হয়ে থাকে, আপনারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

কয়েক বছর আগে চলচ্চিত্রবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে সুচন্দা, ফারুক, ববিতা, সোহেল রানা, আলমগীর ও পপির মতো প্রখ্যাত তারকারা

উল্লেখ্য, নেতা ও অভিনেতা দুই ছিলেন ফারুক। ছিলেন বীরমুক্তিযোদ্ধাও। দেশের মানুষের সেবা করার জন্য জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে হয়েছিলেন সংসদ সদস্য। তবে সবার আগে বলতে হবে তার অভিনয়ের কথা। অসাধারণ এই অভিনেতা জিতেছিলেন সাধারণের মন। হয়ে উঠেছিলেন অনন্য সাধারণ।

মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ‘জলছবি’ সিনেমার মাধ্যমে ঢাকাই সিনেমায় নায়ক ফারুকের অভিষেক। তার অভিনীত শতাধিক সিনেমার সিংহভাগই ব্যবসাসফল। স্বাধীন বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে প্রায় সব শ্রেণির মানুষের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন এই নায়ক। তিনি যেসব সিনেমার মাধ্যমে ‘নায়ক’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘সুজন সখী’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমণি’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘লাঠিয়াল’, ‘সারেং বৌ’, ‘সাহেব’, ‘লাঠিয়াল’, ‘মিয়া ভাই’ উল্লেখযোগ্য।

ববিতার সঙ্গে ফারুকের জুটি হয়ে উঠেছে কালজয়ী 

সংসদ সদস্য হওয়ার পর ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। পরীক্ষায় তার রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এরপর মস্তিষ্কেও সংক্রমণ ধরা পড়ে। আট বছর ধরে ওই হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যর্থ করে ২০২৩ সালের ১৫ মে তিনি মারা যান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর