বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম বা তার সৃষ্টি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এক অপার বিস্ময় তিনি। ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো’, ‘কেনো পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু’, ‘রঙের দুনিয়া’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’- তুমুল জনপ্রিয় এই গানগুলো শুনলেই তাকে আবিষ্কার করা যায় খুব সহজেই। সারাটা জীবন নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করা এই গ্রামীন সমাজের প্রতিনিধি যা সৃষ্টি করে গেছেন তা মানুষকে আরও বহুকাল শিহরিত করবে এটা বলা যায়।
এই কিংবদন্তির ১৫তম প্রয়াণ দিবস ছিলো গতকাল (১২ সেপ্টেম্বর)। কিন্তু রাজধানী কিংবা কোথাও তাকে নিয়ে কোন আয়োজনের খবর শোনা যায়নি। ক’দিন আগে উপমহাদেশের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী ফিরোজা বেগমের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকীও চলে গেলো একেবারে নীরবে নিভৃতে, বলা যায় অবহেলায়। এভাবে গুণীজনদের অবহেলা করলে সে দেশে আর নতুন কোন গুণীর জন্ম হবে কি না না নিয়ে সংশয় থেকেই যায়!
২০০৯ সালের এই দিনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও এই গুণী রেখে গেছেন এক সৃষ্টিশীল কর্মজীবন। তাইতো দিনকে দিন তিনি আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। স্মরিত হচ্ছেন সব শ্রেণির মানুষের কাছে।
শাহ আবদুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীরে বেড়ে উঠেন শাহ আবদুল করিম। তার পিতার নাম ইব্রাহীম আলী ও মাতার নাম নাইওরজান। দারিদ্র্য ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের সংগীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। বাউল সম্রাটের প্রেরণা তার স্ত্রী আফতাবুন্নেসা; যাকে তিনি আদর করে ‘সরলা’ নামে ডাকতেন।
ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে।
আব্দুল করিম এ পর্যন্ত প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। বাউল সাধক শাহ আবদুল জীবনের একটি বড় অংশ লড়াই করেছেন দরিদ্রতার সাথে।
২০০৬ সালে সাউন্ড মেশিন নামের একটি অডিও প্রকাশনা সংস্থা তার সম্মানে জীবন্ত কিংবদন্তী: বাউল শাহ আবদুল করিম নামে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া তার জনপ্রিয় ১২ টি গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী ২০০৯ সালের প্রথম দিকে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।