বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের অনন্য কণ্ঠস্বর ফারুকী: ভ্যারাইটি

সংস্কৃতি অঙ্গন, বিনোদন

মাসিদ রণ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-11-10 21:36:32

একটু আগেই শপথ গ্রহণের মধ্য নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদে যোগ দিলেন দেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তবে তার এই যাত্রাপথ ফুলে মোড়ানো ছিল না। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ফারুকীকে আসতে হয়েছে আজকের অবস্থানে।

তাকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের অনন্য কণ্ঠস্বর’। না, এটা আমার কথা নয়। ২০১৮ সালে যখন ‘ডুব’ সিনেমাটি বাংলাদেশ থেকে অস্কার প্রতিযোগিতায় গিয়েছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিন ভ্যারাইটি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে এই কথাটি বলেছিলো।

ফারুকী পরিচালিত ‘ডুব’ সিনেমায় ইরফান খান ও তিশা

নব্বইয়ের দশক ও পরবর্তী সময়ে কোনো নাটক প্রচার হলে সেখানে বেশির ভাগ সময়ই মধ্যমণি থাকতেন পর্দার সামনের তারকারা। পরিচালকদের নিয়ে তেমন আলোচনা শোনা যেত না। তবে ২৫ বছর আগে ভিন্ন ঘটনা ঘটে। সেই সময়ে নাটক নির্মাণ করে আলোচনায় এলেন এক তরুণ মুখ। শুরুতেই তাকে নিয়ে সমালোচনা। তিনি বাংলা নাটককে ছক-কষা ড্রয়িংরুমের ভাষা থেকে বের করেছেন। শুধু ভাষাই নয়, যার কাজের পুরো চিত্রনাট্য নেই, তিনি কোনো ব্যাকরণও মানেন না। ‘নিয়ম ভাঙছেন’ বলে জোরেশোরে তার সমালোচনায় নিয়ম করে চলতে থাকে। অন্যদিকে কড়া সমালোচনা মধ্যেই মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী নামটি দর্শকদের কাছে হয়ে উঠতে থাকে তারকাদের মতোই আলোচিত। বলছি ছবিয়ালের এই প্রধান মানুষটির কথা। দেখতে দেখতে সেই ছবিয়াল পেরিয়ে গেল ২৫ বছর।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

স্কুল, কলেজ, আড্ডায় বা পরিবারে যেভাবে কথা বলা হতো, যেভাবে কেউ আচার-আচরণ করতেন, সেভাবেই গল্পগুলো তুলে ধরতে থাকেন ফারুকী। প্রথম ‘ওয়েটিং রুম’ সেটাই মনে করিয়ে দেয়। জীবনযাপনকে সহজভাবে পর্দায় তুলে ধরতে গিয়ে তোপের মুখে পড়লেও সমালোচনার ধার ধারেননি তিনি। তথাকথিত রীতি ভেঙে তিনি বাংলা নাটকে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করেছেন।

যিনি তরুণদের বুঝতে পেরেছিলেন। যে কারণে তার নির্মিত ‘চড়ুই ভাতি’, ‘সিক্সটি নাইন’, ‘৫১বর্তী’, ‘৪২০’, ‘ক্যারাম’ নাটকগুলো দর্শকেরা সহজেই আপন করে নিয়েছিলেন। ২০০০ সাল পরবর্তী নাটকের অন্যতম নাম হয়ে ওঠেন ফারুকী। তাঁর কাজ দিয়ে আলোচনায় আসেন মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, নুসরাত ইমরোজ তিশাদের মতো জনপ্রিয় তারকারা।

বেশ পরিণত হয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশাকে বিয়ে করেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

১৯৯৮ সাল, ছবিয়াল থেকে ফারুকীর প্রথম নির্মাণ ‘ওয়েটিং রুম’, সেই সময় কোনো টিভি চ্যানেল কিনতে চায়নি ফিকশনটি। ২৫ বছরে এসে চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নামের আগে যুক্ত হয়েছে বিশেষণ। তিনি এখন অন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো সে স্বীকৃতি দিয়েছে তাকে।

‘ছবিয়াল’ নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মালিকানাধীন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারেই তিনি নির্মাণ করে আসছেন বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা। নিজস্বতা তৈরি করার এই চেষ্টাই অনন্য করে তুলেছে ছবিয়াল ও ফারুকীকে। এ যাত্রায় ছবিয়াল ও ফারুকীকে অনেকেই সাহায্য করেছেন। যাদের মধ্যে চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও চ্যানেল ওয়ানের কর্ণধার গিয়াস উদ্দিন আল মামুন অন্যতম।

ফারুকীর ‘ছবিয়াল’ পরিবার

এর পাশাপাশি ছবিয়াল আরও একটি দৃষ্টান্ত রেখে গেছে দেশের বিনোদন অঙ্গনে। সেটি হলো, ফারুকীর পাশাপাশি তরুণ নির্মাতা তৈরি করা। যারা একসময় সহকারী পরিচালক হিসেবে ছিলেন ছবিয়ালে, তারাই এখন নিজেদের নামে খ্যাতি অর্জন করেছেন। অনেকেই তাদের গুচ্ছ আকারে ‘ভাই বেরাদার’ নামে চেনেন। যাদের মধ্যে অন্যতম রেদওয়ান রনি, আশুতোষ সুজন, শরাফ আহমেদ জীবন, আশফাক নিপুণ, ইফতেখার আহমেদ ফাহমী, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ ও আদনান আল রাজীব।

ছবিয়ালের উল্লেখযোগ্য ফিকশন ও ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে রয়েছ ‘আয়শা মঙ্গল’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘কানামাছি, ‘চড়ুইভাতি, ‘৬৯’, ‘৫১বর্তী, ‘৪২০’। সিনেমার মধ্যে রয়ছে ‘ব্যাচেলর’, ‘টেলিভিশন’, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘ডুব’, পিঁপড়াবিদ্যা’ ইত্যাদি।

 কিশোর বয়স থেকেই তার মাথায় ভর করে সিনেমার ফ্রেম

ফারুকীর বেড়ে ওঠা পূর্ব নাখালপাড়ায়। কিশোর বয়স থেকেই তার মাথায় ভর করে সিনেমার ফ্রেম। পড়াশোনা আর দেশ-বিদেশের সিনেমা দেখে সময় কাটতে থাকে। যার মাথায় ঘুরতে থাকে আকিরা কুরোসাওয়া, ফেদেরিকো ফেলিনি, জ্যঁ-লুক গদার, ফ্রঁসোয়া ত্রুফো, আব্বাস কিয়ারোস্তামিদের মতো খ্যাতনামা সিনেমার দৃশ্যপট, তিনি থেমে থাকার পাত্র নন। বাধা উপেক্ষা করে ফারুকীর কাঁচা হাত শুরু হয় দক্ষতার সঙ্গে নাটক থেকে সিনেমা পরিচালনার কাজ, যা ছিল সময়ের তুলনায় অনেক সাহসের।

ফারুকীর ছবিতে কাজ এ আর রহমান, করেছেন ইরফান খান, নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মতো প্রখ্যাত বলিউড তারকা

ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা ‘ব্যাচেলর’ দিয়েও সমালোচনার মুখে পড়েন এই পরিচালক। এগুলোকেও আগের মতোই তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলেছেন। কারণ, দর্শকদের কাছ থেকে বাহবা পাচ্ছিলেন। ফারুকী মনে করেন তার নির্মিত সব গল্পই, আন্তব্যক্তি সম্পর্কের গল্প। যেখানে চারপাশে দেখা কিছু চরিত্র থাকে। এই চরিত্রগুলো একে অন্যের সঙ্গে ইন্টারেকশন তৈরি করে। এরই মধ্য দিয়ে তৈরি গল্পের ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার, যা প্রতিফলিত করে সমাজ বাস্তবতাকে। যে কারণে পরবর্তী ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘টেলিভিশন’,‘ ডুব’, ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’সহ প্রায় সব সিনেমা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রশংসিত হতে থাকে। হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক নির্মাতা।

ফারুকীর সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’ দীর্ঘদিন সেন্সর বোর্ড আটকে আছে

ফারুকীর সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’ দীর্ঘদিন সেন্সর বোর্ড আটকে আছে। গুঞ্জন রয়েছে, ছবিটি গুলশানের হলি আর্টিসানের সাড়া জাড়ানো ঘটনা নিয়ে তৈরি, তাই বিগত সরকার ছবিটি মুক্তি দিতে চায়নি। এই ছবি মুক্তি দিতে ফারুকীকে দারুণ বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু তিনি থেমে যাননি, লড়াইটা করে গেছেন নিজের মতো করে।

ফারুকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দলবল নিয়ে চলার। সেটা ফিল্ম মেকিংয়ে হোক, কোনো দাওয়াতে হোক বা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দেওয়ার সময়েই হোক, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। যে কারণে ৩/৪ জন সহকারীর জায়গায় ছবিয়াল টিমে থাকত ১০/১২ জন সহকারী। এ জন্যও সমালোচনার মুখে পড়তে হতো। তবে এত সহকারী রাখার কারণ প্রসঙ্গে ফারুকী এক সাক্ষাৎকার জানিয়েছিলেন, তার কাজগুলো জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরে তিনি পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন। তার কাছে মনে হতো, যত মেধাবী তরুণ তার সঙ্গে যুক্ত হবে ততই ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো কাজ হবে।

ঢাকার সিনেমাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে কয়জন সিনেমা দিয়ে তুলে ধরেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফারুকী

তারেক মাসুদ পরবর্তী সময়ে ঢাকার সিনেমাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে কয়জন সিনেমা দিয়ে তুলে ধরেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফারুকী। একই সঙ্গে কমার্শিয়াল ও শৈল্পিক ঘরানার সিনেমা বানিয়ে তিনি অনেক তরুণকেই উৎসাহ জুগিয়েছেন। তরুণেরা কেউ কেউ মনে করেন, ফারুকীই তাদের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র উৎসব চিনিয়েছেন। বুসান, মস্কো, সিঙ্গাপুর, এশিয়া প্যাসিফিকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে নিয়মিত তার সিনেমা মনোনয়ন, পুরস্কার ও প্রশংসা পেয়েছেন।

স্ত্রী অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা ও কন্যা ইলহামকে নিয়ে তার সুখের সংসার

বেশ পরিণত হয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশাকে বিয়ে করেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। শোবিজের আদর্শ দম্পতি হিসেবে সুনাম রয়েছে তাদের। এই দম্পতির ঘর আলো করে এসেছে ইলহাম নামের এক কন্যা সন্তান। যাকে পাওয়ার হৃদয়স্পর্শী ঘটনা নিয়ে ফারুকী নির্মাণ করেছেন ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ সিনেমাটি।

এতে তিশার বিপরীতে অভিনয়ের মাধ্যমে ফারুকী অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ফারুকীর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নির্মাতা হওয়া কিংবা আজকের সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যে সফল ও কঠিণ জার্নি তাতে বরাবরই মেরুদণ্ড হয়ে শক্তি জুগিয়েছেন তিশা। এ কথা ফারুকী বরাবরই স্বীকার করেন।

‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ সিনেমায় অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ফারুকী

এ সম্পর্কিত আরও খবর