চার্লি চ্যাপলিন: প্রথম আন্তর্জাতিক সিনে তারকা

সিনেমা, বিনোদন

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-27 06:31:30

চার্লি চ্যাপলিন (১৬ এপ্রিল ১৮৮৯-২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭) নামে সমধিক পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নাম চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র। প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম নিলেও পরিশ্রম ও মেধায় তিনি পরিণত হন এক বিশ্ববরেণ্য অভিনেতায়।

তাকে গণ্য করা হয় প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র তারকা হিসেবে। অভিনয়, চলচ্চিত্র নির্মাণ, কাহিনী রচনা ইত্যাদির মাধ্যমে তার আগে কেউ সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিতে পারেননি। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা তিনি, যিনি হাসির আড়ালের মানবিক বেদনা তুলে ধরে লাখ লাখ দর্শককে কাঁদাতে পারতেন।

তাঁর সময়কালে তিনি হয়েছিলেন প্রধান সেলিব্রেটি। কোটি মানুষ তার পোষাক, অঙ্গভঙ্গি নকল করতো। প্রজন্মের আইকন ছিলেন তিনি। সুইজারল্যান্ডের কর্সিয়ের-সুর-ভেভিতে চ্যাপলিনের বাড়ি মানোইর দে বানকে 'চ্যাপলিন্স ওয়ার্ল্ড' নামে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। রয়টার্স একে ‘চার্লি চ্যাপলিনের জীবনী ও কাজ প্রদর্শন করা ক্রিয়াশীল জাদুঘর’ বলে বর্ণনা করে।

চ্যাপলিন্স ওয়ার্ল্ড জাদুঘর, সুইজারল্যান্ড

লন্ডনের মিউজিয়াম অব দ্য মুভিং ইমেজ চ্যাপলিনের একটি স্থায়ী প্রদর্শনী রেখেছে এবং ১৯৮৮ সালে তাঁর জীবন ও কর্মজীবনকে উৎসর্গ করে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। লন্ডন চলচ্চিত্র জাদুঘর ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ‘চার্লি চ্যাপলিন - দ্য গ্রেট লন্ডনার’ নামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে।

লন্ডনের লেস্টার স্কয়ারে ১৯৮১ সালে উন্মোচিত দ্য ট্রাম্প চরিত্রে চ্যাপলিনের একটি ভাস্কর্য রয়েছে। মধ্য লন্ডনের এই লেস্টার শহরে চ্যাপলিনের নামানুসারে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় 'চার্লি চ্যাপলিন ওয়াক'।

লন্ডন, হ্যাম্পশায়ার ও ইয়র্কশায়ারে তাঁর নামে নয়টি স্মারক নীল প্লাক রয়েছে। সুইস শহর ভেভিতে তাকে সম্মান জানাতে ১৯৮০ সালে তাঁর নামে একটি পার্কের নামকরণ করে এবং ১৯৮২ সালে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করে। ২০১১ সালে ভেভিতে দু’টি ১৪ তলা ভবনে চ্যাপলিনের চিত্র খচিত দু’টি ম্যুরাল উন্মোচন করা হয়।

আইরিশ শহর ওয়াটারভিলও চ্যাপলিনকে সম্মান জানিয়েছে, যেখানে তিনি ১৯৬০ -এর দশকে তাঁর পরিবার নিয়ে কয়েকটি গ্রীষ্ম কাটিয়েছেন। ১৯৯৮ সালে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয় এবং ২০১১ সাল থেকে এই শহরে বার্ষিক চার্লি চ্যাপলিন হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে আসছে। এই উৎসব চালু করার উদ্দেশ্য ছিল চ্যাপলিনের রেখে যাওয়া কাজ এবং নতুন কৌতুক প্রতিভাসমূহ প্রদর্শন করা।

চ্যাপলিনের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে তাঁর নামানুসারে ১৯৮১ সালে সোভিয়েত জ্যোতির্বিদ লুদমিলা করাচকিনা আবিষ্কৃত একটি ছোট গ্রহের নামকরণ করা হয় ৩৬২৩ চ্যাপলিন। ১৯৮০ এর দশকে আইবিএম তাদের পার্সোনাল কম্পিউটারের প্রচারণায় চ্যাপলিনের মূর্তিটি ব্যবহার করে। ১৯৮৯ সালে সারা বিশ্বে বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে চ্যাপলিনের ১০০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয় এবং ২০১১ সালের ১৫ এপ্রিল তাঁর ১২২তম জন্মবার্ষিকীর আগের দিন গুগল তাদের বৈশ্বিক ও বিভিন্ন দেশের হোমপেজে একটি বিশেষ গুগল ডুডল ভিডিও তৈরি করে তাঁর জন্মদিন উদযাপন করে। বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের অনেক দেশ চ্যাপলিনের চিত্র সম্বলিত পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশের মাধ্যমে সম্মাননা প্রদর্শন করেছে স্যার উপাধি পাওয়া এই শিল্পীকে।

চার্লি চ্যাপলিনের জন্ম সম্পর্কিত বৈধ কোনো প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি, তাই তাঁর জন্ম নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। সংবাদ মাধ্যম তাঁর জন্মস্থান সম্পর্কে নানা সময়ে নানা রকম তথ্য দিয়েছে। কিন্তু চ্যাপলিনের মতে, তিনি দক্ষিণ লন্ডনের ওয়ালওর্থের ইস্ট স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা-বাবা দুজনেই মঞ্চের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Apr/16/1555407816217.jpg
যুবক চার্লি চ্যাপলিন

ইহুদি ধর্মানুসারী ও মুচি পরিবারের সন্তান চ্যাপলিন লন্ডনে প্রচণ্ড দারিদ্র ও কষ্টের মধ্য দিয়ে শৈশব পার করেন। তাঁর বাবার অনুপস্থিতি ও মায়ের অর্থাভাবের জন্য তাকে নয় বছর বয়সের আগের দুইবার একটি কর্মশালায় কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল। যখন তাঁর বয়স ১৪ তখন তাঁর মাকে পাগলাগারদে পাঠানো হয়।

ফলে তিনি জীবনকে দেখেছেন রূঢ় বাস্তবতায়। হাসি, কান্না, দুঃখ, বেদনার অভিনয় করেছেন নিজের অভিজ্ঞতার রসে। ফলে তার অভিনয়ের প্রতিটি অভিব্যক্তিই বাস্তব বলে মনে হয়েছে।

মঞ্চ ও নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি জীবন শুরু করেন এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পান। ১৯ বছর বয়সে তিনি স্বনামধন্য ফ্রেড কার্নো কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন, যারা তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে নিয়ে যায়। চ্যাপলিন সেখানে হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে যুক্ত হন। তারপর তাঁর জীবনে বড় পর্দায় সাফল্য দেখা দেয়।

অচিরেই তিনি তার নিজের সৃষ্ট ভবঘুরে 'দ্য ট্রাম্প' চরিত্রের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন এবং তার অনেক ভক্তকূল গড়ে ওঠে।

'শার্লট' নামে পরিচিত চ্যাপলিনের ট্রাম্প ভবঘুরে হলেও ব্রিটিশ ভদ্রজনোচিত আদব-কায়দায় সুসংস্কৃত এবং সম্মানবোধে অটুট। শার্লটের পরনে চাপা কোট, সাইজে বড় প্যান্ট, বড় জুতো, মাথায় বাউলার হ্যাট, হাতে ছড়ি আর অদ্বিতীয়তম টুথব্রাশ গোঁফ। চ্যাপলিন শুরুর দিক থেকেই তাঁর চলচ্চিত্রগুলো পরিচালনা করতেন। ১৯১৮ সালের মধ্যে তিনি বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন।

তাঁর নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হল 'দ্য কিড' (১৯২১), পরবর্তীতে তিনি আ ওম্যান অব প্যারিস(১৯২৩), দ্য গোল্ড রাশ (১৯২৫) এবং দ্য সার্কাস (১৯২৮) চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং এসব চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেন।

অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন

১৯৩০ এর দশকে তিনি সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এবং নির্বাক সিটি লাইট্স (১৯৩১) ও মডার্ন টাইমস (১৯৩৬) নির্মাণ করে প্রশংসিত হন। চ্যাপলিন তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্র ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ (১৯৪০) এ অতিমাত্রায় রাজনৈতিক হয়ে ওঠেন এবং আডলফ হিটলারকে ব্যঙ্গ করেন।

১৯৪০ এর দশকে চ্যাপলিনকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় এবং তাঁর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। তিনি সমাজতান্ত্রিকদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে অভিযোগ ওঠে, পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে পিতৃত্বের মামলা চলাকালে তিনি কম বয়সী অপর এক মহিলাকে বিয়ে করায় তাঁকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হয়।

তারপরও তাঁর চলচ্চিত্র দর্শক হারায়নি। পরবর্তীতে তিনি মঁসিয়ে ভের্দু (১৯৪৭), লাইমলাইট (১৯৫২) আ কিং ইন নিউ ইয়র্ক (১৯৫৭) এবং আ কাউন্টেস ফ্রম হংকং (১৯৬৭) চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয় করতেন, এবং চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমনকি সঙ্গীত পরিচালনাও করতেন। তিনি তাঁর সব চলচ্চিত্র ত্রুটিমুক্ত রাখার চেষ্টা করতেন এবং তাঁর আর্থিক স্বাধীনতার কারণে তিনি একটি চলচ্চিত্রের গল্পের বিকাশ ও চলচ্চিত্র নির্মাণে অধিক সময় ব্যয় করতে পারতেন। তার চলচ্চিত্রগুলোতে বৈরিতার সাথে দ্য ট্রাম্পের সংগ্রামের করুণ রসের সাথে স্ল্যাপস্টিক হাস্যরস বিদ্যমান ছিল। কয়েকটি চলচ্চিত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ছিল এবং কয়েকটিতে আত্মজীবনীমূলক উপাদান ছিল।

চ্যাপলিনকে ১৯৭২ সালে চ্যাপ একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কারপ্রদান করা হয়। শিল্পকলায় অবদানের জন্য তাঁকে ফ্রান্স সরকার ১৯৭১ সালে লেজিওঁ দনরের কমান্ডার ও রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৭৫ সালে নাইটহুডে ভূষিত করেন।

চলচ্চিত্র নির্মাতা চার্লি চ্যাপলিন

মৃত্যুর পরও চ্যাপলিন তাঁর নির্মিত দ্য গোল্ড রাশ, সিটি লাইট্স, মডার্ন টাইমস ও দ্য গ্রেট ডিক্টেটর চলচ্চিত্র দিয়ে অমর হয়ে আছেন। এই চলচ্চিত্রগুলোকে প্রায়ই চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা তালিকায় স্থান করে নিতে দেখা যায়।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর