ফুটবলার হতে না পেরে নাট্যকার হলেন বৃন্দাবন দাস

ছোটপর্দা, বিনোদন

নজরুল ইসলাম তোফা | 2023-09-01 23:04:24

পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। তবে সফলতার সীমা পরিসীমা নেই। যে যার মতো সফল হয়ে তুষ্ট থাকেন। আবার কেউ সফলতার সীমানা নির্ধারণ করতে পারেন না, অসন্তুষ্টি নিয়ে তারা সারা জীবন পার করেন। প্রকৃত ও যথার্থ পরিশ্রম একটি মানুষের জীবনে ‘সৌভাগ্যের লক্ষ্মী’ ডেকে আনে। বলতে চাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী নাট্যকারের কথা।

ভালো ফুটবল খেলতেন। তার স্বপ্নও ছিল তিনি সেরা ফুটবলার হবেন। কিন্তু দেশসেরা ফুটবলার তিনি হতে পারেননি। হয়তো বা সেই সফলতার জায়গা তার জন্য নয়। তার জায়গা হলো- নাটক লেখা, নাটক করা আবার তা পরিচালনা করা। তিনি হলেন প্রখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক পাবনা জেলার কৃতী সন্তান বৃন্দাবন দাস। দেশসেরা ফুটবলার হতে না পারলেও দেশসেরা নাট্যকার হলেন বৃন্দাবন।

তার ইচ্ছা ছিল ফুটবলে জাতীয় দল তথা আবাহনীর হয়ে আকাশি-নীল রঙের জার্সি গায়ে দিয়ে খেলবেন। ১৯৮১ সালে এই স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে অচেনা শহর ঢাকায় এলেন। আবাহনী ক্লাবে হাজির হয়ে স্বপ্নের সেই কথাগুলো জানান কিংবদন্তিতূল্য ফুটবলার অমলেশ সেনের কাছে।

কিন্তু মনোবাসনার কথা জানানোর পর সেখান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন পাবনার চাটমোহরে। অমলেশ সেন তাকে বুঝে উঠতে না পারলেও তিনি ১৯৮৪ সাল হতে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চাটমোহর সবুজ সংঘের এক অন্যতম সংগঠক ও কৃতী ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

যমজ দুই সন্তানের সাথে বৃন্দাবন দাস/ ছবি: সংগৃহীত

 

পাবনা জেলা যুব ফুটবল দলসহ পাবনা মোহামেডান ক্লাব ও পাবনা ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশগ্রহণসহ ঢাকা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের সিটি ক্লাব, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব ও আদমজি জুট মিলস এর অন্যতম খেলোয়াড় মনোনীত হয়েছিলেন।

কিন্তু অনুশীলনের সময় আহত হয়ে অনেক দিন মাঠের বাইরে থাকতে হয় বৃন্দাবন দাসকে। বিভিন্ন জেলায় টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে বেশ কয়েকটিতে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪-৮৬ সাল পর্যন্ত পর পর তিন বছর চাটমোহর উপজেলার বর্ষসেরা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে সবুজ-পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।

পাবনায় ফুটবল খেলার মাঠের পাশেই ছিল চাটমোহর সাংস্কৃতিক পরিষদ। নাটক করা যায় কিনা! যথারীতি সেখানে তিনি উপস্থিতও হয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালের কথা। সাংস্কৃতিক পরিষদের পরিচালক গোলাম মোহাম্মদ ফারুককে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘নাটকে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে।’ এ কথা শুনে গোলাম মোহাম্মদ ফারুক তাকে সালাম সাকলায়েন রচিত 'চোর’ নাটকে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। সেখান থেকেই তার সৃষ্টিশীলতার শুরু।

এরপর সেখানেই বাংলাদেশ মুক্ত-নাটক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। সেই সুবাদে ‘আরণ্যক নাট্যদল’-এর কর্ণধার- মামুনুর রশীদের সঙ্গে পরিচয় এবং ঢাকার আরণ্যক নাট্যদলের সদস্য পদ লাভ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মামুনুর রশীদের সহকারী হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।

স্ত্রী শাহনাজ ফেরদৌস খুশি ও দুই ছেলের সাথে বৃন্দাবন দাস/ ছবি: সংগৃহীত

 

তারপর ১৯৯৪ সালে বৃন্দাবন দাস বেশ কিছুদিন অবশ্য কাজ করেছিলেন ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে জুনিয়র অফিসার পদে। ১৯৯৭ সালে আরণ্যক ছেড়ে তিনি ‘প্রাচ্যনা্ট’ গঠন করেন। তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘কেয়ার বাংলাদেশে’ কাজ করেন ২০০৬ সাল পর্যন্ত।

বৃন্দাবন দাস জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৬৩ সালে ৭ ডিসেম্বর- পাবনা জেলার চাট মোহর উপজেলার সাঁরোড়া গ্রামে। বৃন্দাবন দাসের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চাটমোহরে। ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার চিন্তা এখনো তিনি নাটকেই যেন ব্যবহার করেন। তিনি পড়াশোনাতেও খুব মনোযোগী ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করার পরে চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু সম্ভুনাথ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি আর চাটমোহর ডিগ্রি কলেজ অর্থাৎ বর্তমানে চাটমোহর সরকারি কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন।

পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জগন্নাথ কলেজও পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএসএস (সম্মান) ও এম এস এস ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে চাটমোহরের মেয়ে শাহনাজ ফেরদৌস খুশির সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। খুশিও একজন প্রখ্যাত অভিনেত্রী। তাদের 'যমজ পুত্র সন্তান দিব্য জ্যোতি আর সৌম্য জ্যোতি এখন অধ্যয়নরত এব উভয়েই অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং এখন পুরো পরিবার মিডিয়া জগতের সঙ্গে যুক্ত।

বৃন্দাবন দাসের গুণাবলির মূল উত্তরসূরি তার বাবা স্বর্গীয় দয়াল কৃষ্ণ দাস। তিনি ১৯২৫ সাল হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত একজন প্রখ্যাত কীর্তন শিল্পী; পদাবলী কীর্তন এবং সাহিত্যে যেন 'অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী' ছিলেন। দয়াল কৃষ্ণ দাস প্রায় ৫০ বছর কীর্তন গেয়ে ছিলেন। তার মাতা ময়নারানী, তিনিও সংস্কৃতিমনা ছিলেন।

প্রাচ্যনাটের প্রয়োজনে ছোট একটি মঞ্চ নাটক 'কাঁদতে মানা' লিখেছিলেন বৃন্দাবন। মূলত এ নাটকটি মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে প্রাচ্যনাটের শুভ যাত্রা হয়। এরপর প্রখ্যাত নাট্য-পরিচালক সাইদুল আনাম টুটুলের পরিচালনায় নির্মিত হলো বৃন্দাবন দাসের লেখা প্রথম টেলিভিশন ধারাবাহিক-নাটক ‘বন্ধুবরেষু’। নাটকটি ১৯৯৯ সালে একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত ও দর্শকনন্দিত হয়।

পাবনার আঞ্চলিক ভাষাকে বৃন্দাবন তার নাটকে শক্তিশালী এক বৃহৎ স্থান করে দিয়েছেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য নাটক: বন্ধুবরেষু, মানিক চোর, বিয়ের ফুল, ঘরকুটুম, পাত্রী চাই, হাড় কিপটে, গরু চোর, আলতা সুন্দরী, সার্ভিস হোল্ডার, ভালোবাসার তিন কাল, সাকিন সারি সুরি, লেখক শ্রীনারায়ণ চন্দ্রদাস, কতা দিল্যেমতো, মোহর শেখ, ওয়ারেন, টক শো, পত্র মিতালী, ফিরে পাওয়া ঠিকানা, সম্পত্তি, সম্পর্ক, উঁট, ডায়রী, কাসু দালাল ও তিন গেদাসহ প্রায় দুই শতাধিক নাটক রচনা করেছেন। তার লেখা মঞ্চ নাটক : কাঁদতে মানা, দড়ির খেলা, অরণ্য সংবাদ, কন্যা ইত্যাদি।

নাটকে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ 'বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি' ও 'বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন' কর্তৃক সেরা নাট্যকারের পুরস্কার পেয়েছেন বৃন্দাবন দাস। তাছাড়া তিনি বিনোদন বিচিত্রা, টেনাশিনাস, ট্যাব, আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ড, প্রতিবিম্ব (অস্ট্রেলিয়া) সহ বহু সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন।

লেখক: নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও প্রভাষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর