ডা. এজাজের চোখে দেখা হুমায়ূন আহমেদ

বিবিধ, বিনোদন

মাহবুবর রহমান সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 05:12:26

এজাজুল ইসলাম পেশায় চিকিৎসক। ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রধান তিনি। তবে তাকে ডা. এজাজ নামে পরিচয় করিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের ৫টি সিনেমাসহ বহু নাটকে কাজ করেছেন ডা. এজাজ। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও।

ডা. এজাজ দীর্ঘ ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে খুব কাছ থেকে দেখেছেন হুমায়ূন আহমেদকে। হুমায়ূন আহমেদের চলে যাওয়ার ৭ বছরে ঠিক মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে শুনিয়েছেন সেই গল্প।
প্রথম দেখা ও প্রথম কাজ
১৯৮৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার মেডিসিনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন এজাজুল ইসলাম। তারপর কয়েক বছর পার হলেও সার্টিফিকেট নেওয়া হয়নি। ১৯৯২ সালে গেলেন সার্টিফিকেট নিতে। সার্টিফিকেট নিতে হবে প্রফেসর ড. এম এ করিমের কাছ থেকে। যিনি হুমায়ূন আহমেদের স্কুলবন্ধু। চেম্বারে গিয়ে জানতে পারেন, হুমায়ূন আহমেদের অফিসে গেছেন ড. এম এ করিম। সার্টিফিকেটে সই নেওয়ার অজুহাতে হুমায়ূন আহমেদের কাকরাইলের অফিসে ছুটে যান এজাজুল ইসলামও।

ডা. এজাজ বলছিলেন, ‘যেই সময় কাকরাইলে রওনা দেই সেই সময় সার্টিফিকেট ওঠানোর ব্যাপারটা মাথায় ছিল না, মাথায় ঘুরছিল—আজ আমার হুমায়ূন আহমেদে স্যারের সঙ্গে দেখা হবে। সেদিন আমার প্রথম স্যারের সঙ্গে দেখা হয়।’
প্রথম আলাপচারিতায় হুমায়ূন আহমেদ এজাজুল ইসলামের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কোথায় পড়েন, কোন বিষয়ে, কী করেন, কোথায় থাকেন এসব। যখন হুমায়ূন আহমেদ জানলেন এজাজুল ইসলাম গাজীপুরে থাকেন ও চাকরি করেন তখন বলেছিলেন, ‘আমি তো গাজীপুরে শুটিং করি। অনেক ঝামেলা হয়। অনেক সহযোগিতারও প্রয়োজন হয়। তোমার যদি সময় হয় আমাকে একটু সহযোগিতা কর।’ প্রথম দেখায় হুমায়ূন আহমেদের কাছাকাছি যেয়ে কাজের প্রস্তাব পেয়ে হতবাক হয়েছিলেন এজাজুল ইসলাম। সেদিন শুধু মাথা নেড়ে টেলিফোন (টিএনটি) নম্বর দিয়ে এসেছিলেন তিনি।

দুই সপ্তাহ পরে হুমায়ূন আহমেদ ফোন করে এজাজুল ইসলামকে বলেছিলেন, 'আমি সবুজ সাথী নামে একটি সিরিয়াল করব। এটার জন্য লোকেশন ও থাকার জায়গা দরকার। তুমি ব্যবস্থা করে দাও?’ সেদিন ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এজাজুল ইসলাম শুধু বলেছিলে, ‘স্যার আমি আপনার অফিসে আসছি। এসে কথা বলছি।’ সেই থেকে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে এজাজুল ইসলামের পথচলা শুরু।

এজাজুল ইসলাম থেকে ডা. এজাজ
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালে প্রথম মঞ্চে অভিনয় করার সুযোগ পান এজাজুল ইসলাম। তার অভিনয়ে দর্শকরা হেসে উঠেছিল, যা তার অভিনয়ের ব্যাপারে আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। এরপর ১৯৭৮-১৯৮৪ সাল পর্যন্ত রংপুর রেডিওতে কাজ করেন এজাজুল ইসলাম। তারপর চাকরির পাশাপাশি টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের তীব্র আগ্রহ থেকে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের অভিনয় শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু থিয়েটারের কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি কোন নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পাচ্ছিলেন না।

‘সবুজ সাথী’ সিরিয়ালের শুটিং চলাকালেও এসব কিছুই জানতেন না হুমায়ূন আহমেদ। শুটিং এর মাঝামাঝি সময়ে এজাজুল ইসলাম একদিন জানালেন সেসব কথা। সেদিন হুমায়ূন আহমেদ শুধু বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে। আমি কালকেই তোমাকে সুযোগ দিচ্ছি।’ পরের দিন হুমায়ূন আহমেদ এজাজুল ইসলামের জন্য একটি সিকুয়েন্স লিখলেন। সেটার নাম ছিল ‘স্বাস্থ্য কর্মী’। সেদিন সেই দৃশ্যে অভিনয় করার পর হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘এই আমাদের ডাক্তার তো ভালো অভিনয় করে’। সেই থেকে শুরু হলো এজাজুল ইসলামের অভিনয় জীবন। আর সেখান থেকেই এজাজুল ইসলাম থেকে হয়ে উঠলেন ডা. এজাজ।
শুটিংয়ের সময়ে হুমায়ূন
‘হুমায়ূন আহমেদের শুটিং সেটে কাজ ছাড়া অন্য কিছু ভাবার বা মোবাইলে কথা বলার চিন্তা করারও সাহস পেতাম না আমরা। উনি যেমন কাজের প্রতি মনযোগী থাকতেন সেটের সবাই তেমন মনযোগী থাকতে বাধ্য হতো। স্যার ভুল করলে বকতেন কিন্তু সেই বকায় অসম্ভব এক মায়া ছিল।’

শুটিংয়ের সময়ে কেমন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ এমন প্রশ্নের এভাবেই উত্তর দিচ্ছিলেন ডা. এজাজ। শুটিং সেটে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সাদামাটা। পরনে থাকত সাধারণ পোশাক। হুমায়ূন আহমেদের জন্য শুটিং সেটে থাকত না আলাদা কোন চেয়ার। তবে একটি নিয়ম ছিল তিনি যে চেয়ারে যেদিন বসতেন সেই চেয়ারে অন্য কেউ বসতেন না। ডা. এজাজ অনেক দিন দেখাশোনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদের প্রোডাকশনের কাজ।

সেই গল্প বলতে ডা. এজাজ বলেন, ‘স্যারের কাছে সবাই সমান ছিল। স্যার আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ডাক্তার শুটিং সেটে আমি যা খাব আমার সেটের প্রোডাকশন বয়ও তাই খাবে। আমার জন্য বিশেষ কোন খাবার হবে না। সবার জন্য একই আয়োজন যেন থাকে।’ স্যার যে খাবার খেয়েছেন সবাই তা-ই খাচ্ছে কিনা তা তদারকি করতেন। রমজান মাসজুড়ে শুটিংয়ের কাজ চলত ঈদের জন্য। সেই সময় ইফতারের আগে নিয়ম ছিল সবাই গোসল করে অজু করে ইফতার করার। সেই গল্পে এজাজ জানালেন, ‘রমজান মাসে স্যার মজা করে বলতেন তোমাদের আমার ভয়ে হলেও নামাজ পড়তে হবে।’
কাজপ্রেমী হুমায়ূন
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন কাজপ্রেমী। কাজের প্রতি তিনি ছিলেন যথেষ্ট দায়িত্ববান। কেমন কাজপ্রেমী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ সেই প্রশ্নের উত্তরে ডা. এজাজ বলেন আরেক গল্প—‘স্যারের একবার বাইপাস অপারেশন করা হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার ১৫ দিনের মাথায় ফোন করে ডেকেছিলেন আমাকে। আমি মনে করেছিলাম স্যারের অপারেশন লাগেনি। কিন্তু স্যারের বাসায় যেয়ে শুনলাম স্যারের অপারেশন শেষ। স্যার সেদিন আমাকে দেখে প্রথম বলেছিলেন, ‘ডাক্তার শুটিং করব তুমি সব কিছু রেডি কর’। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, স্যার এখন অনেক গরম, কয়েকদিন পরে কাজ শুরু করি।’

ডা. এজাজের দেখা একমাত্র ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ যিনি বাইপাস অপারেশনের পর এত কম সময়ে কাজ শুরু করেছেন আর সেই কাজে কোন অসুস্থতা, বিরক্তি, অমনোযোগ বা ক্লান্তির ছাপ ছিল না।

হুমায়ূনের জাদু
ডা. এজাজের জীবনে সরাসরি হুমায়ূন আহমেদের জাদু দেখার সুযোগ হয়েছে একবার। সেই জাদু তিনি দেখেছিলেন ‘রূপালী রাত্রি’ নাটকে শুটিংয়ের জন্য সুইজারল্যান্ড গিয়ে। সেই নাটকের একটি দৃশ্য ছিল স্বাধীন খসরুর। দৃশ্যটি হলো—খালি হাত, হাত মুঠি করে খুললে দেখা যাবে টাকা। দৃশ্য ধারণের আগে হুমায়ূন আহমেদ বেশ কয়েকবার দেখিয়েছিলেন সেই জাদু।

হুমায়ূনের খাবার
‘স্যার খুব অল্প খেতেন তবে খাবার ব্যাপারে ছিলেন খুবই রুচিশীল। হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল ইলিশ মাছ, শিং মাছ, চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা, মাসকলাইয়ের ডাল, গরু ও খাসির গোস্ত। তিনি দুধ চা খেতেন।’ তবে ডায়াবেটিকস ধরা পড়ার পর চায়ে চিনি খেতেন কি না সে কথা মনে নেই ডা. এজাজের।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক
হুমায়ূন আহমেদ ডা. এজাজকে ডাক্তার বলে ডাকতেন। আর ডা. এজাজ হুমায়ূন আহমেদকে ডাকতেন স্যার বলে। নিজেদের সম্পর্কে বিষয়ে ডা. এজাজ বলেন, ‘স্যার আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন, খুব মায়া করতেন, খুব ভালোবাসতেন। এতটাই বিশ্বাস করতেন যে, আমি শুটিং লোকেশন দেখে আসলে স্যার বলতেন ডাক্তার তোমার পছন্দ হয়েছে তো? আমি হ্যাঁ বললে তিনি লোকেশন না দেখতে যেয়ে বলতেন তোমার পছন্দ হয়েছে তাতেই হবে।
নুহাশ পল্লীর ব্যাপারে ডা. এজাজ জানালেন, ‘অদেখা ভুবন’-এর শুটিংয়ের জন্য বাসে করে যাচ্ছিলাম আমরা। স্যার সামনের দিকে বসা। আমাকে ডেকে বলছিলেন, ডাক্তার আমার একটা সুন্দর বাগানবাড়ির স্বপ্ন। অনেককে বলেছি, সবাই বলে স্যার দেখব। কিন্তু কেউ আসলে দেখে না। আমাকে বলেই যায় দেখব। পরে কেউ দেখে না। আমি শুধু তোমাকে দায়িত্ব দিলাম তুমি আমাকে একটা জায়গা দেখে দেবে। কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নাই। এ দায়িত্ব শুধুই তোমার। সেই ছবির শুটিং শেষ করার পর অনেক খোঁজাখুঁজি করে এখনকার নুহাশ পল্লীর জায়গাটা স্যারকে খুঁজে দেই। স্যার অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। নুহাশ পল্লীর জায়গা দেখে আসার পর স্যার আমাকে বলেছিলেন, ডাক্তার আমার জীবনে অনেক বড় একটা স্বপ্ন তোমার মাধ্যমে আল্লাহ পাক পূরণ করে দিলেন। আরও বলছিলেন, তুমি কী চাও? আমি বলেছিলাম স্যার আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই। হুমায়ূন আহমেদ একবার স্বপ্ন দেখেছিলেন কয়েকটি বাচ্চা কোলে নিয়ে তার সামনে কয়েকজন ঘুরছে। সেকথা বলেছিলেন ডা. এজাজকে। সেই থেকে এজাজের পরামর্শে প্রায়ই নিজের স্কুলে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করতেন হুমায়ূন আহমেদ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর