মাইয়া তুই অপরাধী...

, বিনোদন

ড.শাখাওয়াৎ নয়ন | 2023-08-27 17:28:36

সম্প্রতি “অপরাধী” শিরোনামে একটি গান বাংলাদেশে সুপার হিট হয়েছে। ছ্যাকামাইসিন ঘরানার এই গানটি এখন দেশের তরুন সমাজের ক্রেজ। এমনকি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা পর্যন্ত এই গানটি গেয়ে ফেইসবুকে শেয়ার করেছে।

অনেকটা আঞ্চলিক ভাষায়/উচ্চারণে গানটি লিখেছেন এবং গেয়েছেন আরমান আলিফ। গানটির কয়েকটি লাইন বেশ ভালো লেগেছে। “টিফিনের সব টাকা জমাই আবেগ কিনিতাম”। আবেগ বলতে গীতিকার কি বুঝিয়েছেন? ফ্লেক্সিলোড? এই লাইনটিতে এক ধরনের দ্ব্যার্থবোধকময় সুন্দর ব্যঞ্জনা আছে। আবার কিছু কথা এরকম “তোর নামের পাশে সবুজ বাতি আর তো জ্বলে না/এখন রাত্রি জুইড়া কেউ তো আর মায়া লাগায় না”। এক কথায় অসাধারণ।

যেখানে সাবেক প্রেমিকার “মাইয়ার” বিষয়ে ব্যাপক ভালোবাসা, অভিযোগ এবং অভিমান প্রকাশিত হয়েছে। পক্ষান্তরে, কয়েকজন মেয়েও এই গানের উত্তরে সাবেক প্রেমিক “পোলা তুই অপরাধী” লিরিক্স সংযোজন করে গানটি গেয়েছে। উঠতি বয়সী তরুন-তরুনীরা গানটি শুনছে, লাইক দিচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই গানটি এত জনপ্রিয় হলো কেন? বর্তমানে কি প্রেমে ব্রেক-আপের সংখ্যা/হার খুব বেড়ে যাচ্ছে/গেছে?

প্রেমে ব্রেক-আপ ছিল না কখন? এডাম এবং লিলিথের প্রেমের ব্রেক-আপই প্রথম ব্রেক-আপ। বাইবেলে তার বর্ননা আছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যে এখন থেকে দেড় শো বছর আগেও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “যদি আর কারে ভালোবাসো, আর যদি ফিরে নাহি আসো” “আমার প্রানের পরে চলে গেল সে”। উকিল মুন্সীর গান “আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, করো তোমার মনে যাহা লয়”। শচীন দেব বর্মনের, “তুমি আর নেই সে তুমি”। ফোক গান আছে “জ্বালাইয়া গেলি মনের আগুন, নিভাইয়া গেলি না”, মমতাজ গেয়েছেন, “বুকটা ফাইট্টা যায়”। নব্বই দশকে আইয়ুব বাচ্চুর অসম্ভব জনপ্রিয় গান “সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে” "মাইলসের গান “ফিরিয়ে দাও...আমারই প্রেম তুমি ফিরিয়ে দাও”।

এই যে এতো গুলো জনপ্রিয় গানের কথা বললাম, এগুলো সবই বিরহের গান। তার মানে কি? বিরহের গান কি বেশি জনপ্রিয় হয়? নাকি বিরহের গান বেশি দিন মনে থাকে? কেউ কেউ বলেন, বাংগালি দুঃখ বিলাসী, তাই এমনটা হয়। সিনেমা দেখে চোখে পানি এলে বলে ছবিটা দারুন। যে কারনে দেবদাস চরিত্র এখনো জনপ্রিয়, এখনো প্রাসঙ্গিক। সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, অনগ্রসর সমাজের শিল্প-সাহিত্যে বিরহ রসের আধিক্য থাকে। কারন এটা আর্থ-সামাজিক কাঠামো, ক্ষমতা সম্পর্ক, কোয়ালিটি অফ লাইফ এবং উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সংগতিপুর্ন। অত্যাধুনিক সমাজে হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে আত্মহত্যা করতে খুব একটা দেখা যায় না। জাপানের টোকিও শহরে আত্মহত্যার হার আশংকাজনক ভাবে বেশি। বিভিন্ন রকম ফিকশনে (অলীক কল্পনায়) ভুগতে ভুগতে অসুস্থ হয়ে যায়, এক পর্যায়ে আত্মহত্যা করে। কিন্তু তারা প্রেমের কারনে আত্মহত্যা করে না।

প্রেম কিংবা মনস্তত্ত্বে ফ্রয়েড যেমন যৌনতার প্রভাবের কথা বলেছেন; তেমনি আমরা মন্টেস্কুর দর্শনেও এটা বিশ্লেষণ করতে পারি। মানুষের সকল কর্ম-কান্ডের উপরই আবহাওয়া-জলবায়ুর প্রভাব আছে। আবহাওয়া-জলবায়ু মানুষকে উদাস করে, প্রেমাকুল করে। “আইলো দারুন ফাগুন রে, একা একা ভালো লাগে না” টাইপ অনুভুতি হয়। সুতরাং আমাদের প্রাচ্যীয় দর্শনে বৈরাগ্য সাধন কিংবা দেবদাস হয়ে যাওয়া একটি প্রাকৃতিক প্রপঞ্চও বটে। আবার সমাজের ক্লাস সিস্টেম (মার্ক্সীয় শ্রেনী বৈষম্য) তথা ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান, বর্ণ পরিচয়ও (হিন্দুদের মধ্যে ব্রাম্মন, ক্ষত্রীয়, শুদ্র, বৈশ্য এবং মুসলিমদের মধ্যে শেখ, সৈয়দ, মোঘল, পাঠান) ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ককে (বিবাহ) নির্ধারণ করে। আপনাদের নিশ্চয়ই এক সময়ের সুপার হিট সিনেমা “বেদের মেয়ে জোছনা”র কথা মনে আছে। উক্ত সিনেমায় মূলতঃ সামন্তবাদী একটি সমাজের চিত্র উপস্থাপণ করা হয়েছে। রোমিও জুলিয়েটও সামন্তবাদী সমাজের প্রেম কাহিনী। এখনকার হলিউডের সিনেমাতে এ ধরনের কাহিনী দেখা যায় না।

প্রাচীন ভারতীয় সমাজের ধর্মীয় সাহিত্য অনেক বেশি সুয়োরিয়েলিস্টিক (নিয়তিবাদী); ব্যক্তির জীবনে যা কিছুই ঘটে, তার সবই দেব-দেবতার লীলা-খেলা। সবই পুর্ব নির্ধারিত। দেব-দেবীরা স্বৈরাচার টাইপ কাজ-কর্ম করতো। তাদের কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। বাল্মিকীর রামায়ন তো অসাধারন ইন্টারেস্টিং গল্প। রামায়ন একই সাথে ফাইটিং এবং একশন (রাম-রাবনের যুদ্ধ) নির্ভর গল্প, আবার সীতার বনবাস বিবেচনায় নিলে বিরহ প্রধান গল্প। আমাদের দেশের বেহুলা-লক্ষীন্দরও একটি চরম নিয়তিবাদী গল্প। এগুলো প্রাচীন সমাজের সাহিত্যের একটা ধরণ/প্রকরণ মাত্র। এ ধরনের নিয়তিবাদী সাহিত্যের খোঁজ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও পাওয়া যায়, গ্রীক লেখক হোমারের “ইডিপাস” এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আরব্য রজনীর গল্পের লায়লা-মজনু’র কথা যদি কল্পনা করি- লায়লার বিয়ে হয়ে গেছে, উটের পিঠে চড়ে লায়লা বরের সাথে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে; অসম্ভব উত্তপ্ত বালু, মরুপথে মজনু পড়িমরি করছে আর গাইছে “ও মাইয়া ও মাইয়া রে...তুই অপরাধী রে, আমার যত্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরাইয়া দে”। কিংবা ইউসুফ-জোলেখার প্রেমের কথা মনে আছে? কল্পনা করুন, রাজবধু জোলেখা যদি ফেরাউনের বিচারালয়ে সুদর্শন যুবক ইউসুফের উদ্দেশ্যে গেয়ে উঠে “ও পোলা ও পোলা রে... তুই অপরাধী রে...তোর ক্ষমা নেই রে”।

------------------------------------------------------------------
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।

এ সম্পর্কিত আরও খবর