‘মায়াবতী’ হোঁচট খেলো চিত্রনাট্য ও সংলাপে

সিনেমা, বিনোদন

রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ, অতিথি লেখক, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-12-27 20:11:21

সিনেমা নাম: মায়াবতী
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: অরুণ চৌধুরী
অভিনয়: নুসরাত ইমরোজ তিশা, ইয়াশ রোহান, ফজলুর রহমান বাবু, আব্দুল্লাহ রানা, আবিদ রেহান, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, আফরোজা বানু প্রমুখ।
প্রযোজনা: আনোয়ার আজাদ ফিল্মস
মুক্তির তারিখ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯
রেটিং: ৫.৫/১০

ঢালিউডে ভোলবদল প্রায়ই হয়। নতুন ভাবনার নতুন পরিচালক নতুন গল্পের সিনেমা নিয়ে হাজির হন। নতুন ভাবনার সিনেমা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়।

অরুণ চৌধুরী পরিচালিত সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘মায়াবতী’ সিনেমাটি সেরকম একটি সিনেমা। নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের ওপর সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে। আর সেই বিষয়টি হলো, নারীর ‘না’ বলার অধিকার। অর্থাৎ কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। তার ‘না’ মানেই ‘না’। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘নো মিনস নো’।

এই প্রতিপাদ্যে বলিউডে ‘পিঙ্ক’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী। সেখানে মিনালকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি করতে গেলে আত্মরক্ষার তাগিদে আক্রমণকারীদের বোতল ছুঁড়ে মারেন তিনি।

তবে এখানে ‘মায়াবতী’কে সম্পূর্ণ মৌলিক সিনেমা হিসেবে ধরতে চাই। মৌলিক সিনেমা হিসেবেই সিনেমাটির ময়নাতদন্ত করা যাক।

 



‘মায়াবতী’র প্রেক্ষাপট
সিনেমাটির কাহিনী মায়াকে নিয়ে শাখা প্রশাখা গজিয়েছে। শিশু মায়াকে গ্রামের দুই স্ত্রীওয়ালা বয়স্ক লোক বিয়ে করতে চায়। তখন মায়ার মা রাজি হয় না। সেকারণে সে মায়াকে গ্রামের এক মামার সাথে শহরে পাঠিয়ে দেয়। মামা মায়াকে নিয়ে এসে দৌলতদিয়া যৌন পল্লীতে বিক্রি করে দেয়।

তখন গানের শিক্ষক মাতাল খোদা বক্স মৃধা যৌন লালসা পূরণের জন্য মায়ার ঘরে যায়। মায়া তখন মায়ের শিখিয়ে দেয়া ‘ছেড়ে দে নৌকা যাব মদিনায়’ গানটি গাওয়া শুরু করে। কারণ, তার মা বলেছিল, বিপদ আসলে গানটি গাইতে। মায়া গান গাইলে তার গলা শুনে মুগ্ধ হয় খোদা বক্স মৃধা। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে যৌনপল্লীর রানিকে বলে, মায়াকে সে গান শেখাবে। কোনো পুরুষের মনোরঞ্জন যেন তাকে দিয়ে না করানো হয়।

 

এভাবে মায়া যৌন পল্লীতে বেড়ে ওঠে। বড় হয়ে সে যৌনপল্লীর বাইরের একটি গেরস্থ বাড়ির ছেলে ইকবালের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ইকবালের মাও মায়াকে তার ছেলের হবু স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়।

একদিন মায়া শহরে গান গাইতে গেলে সেখানে মায়া তার ওস্তাদ খোদা বক্স মৃধার খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ে। আকবর আলী জোর করে মায়াকে শ্লীলতাহানি করতে গেলে মায়া তাকে মোমদানি দিয়ে আঘাত করে। সেজন্য আকবর আলীর সহযোগী বাদশা আলম খোদা বক্স মৃধাকে খুন করে।

মূলত, খোদা বক্সকে খুন ও মায়াকে ধর্ষণের ইচ্ছা ছিল অনেক বছর আগে থেকে। মায়া যখন ছোট ছিল তখন তাকে ছুঁতে গেলে খোদা বক্স মৃধা রেগে গিয়ে বাদশা আলম ও আকবর আলীকে থাপ্পড় মারে। পরবর্তীতে আদালতে মায়া নির্দোষ প্রমাণিত হয়। যদিও মায়া সমর্থন পেয়েছে দেশের মিডিয়া ও সমাজকর্মীদের।

প্রচারণায় নারী মুক্তির বিষয়টি বলা হচ্ছিল। কিন্তু নারী মুক্তি আসলে কিসে হয়? নিজ অথবা পুরুষের বন্দী দশা থেকে মুক্ত হওয়া। মায়া চরিত্রটি শুরু থেকেই বন্দী ছিল। শেষে যখন সে মামলা থেকে রেহাই পেলো, গানের প্রস্তাব নিয়ে বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী আইয়ুব মজুমদার আসল তার কাছে। সে গান রেকর্ডিং করল। এর মাধ্যমে মায়া রেড লাইট এলাকা থেকে রেহাই পেলো। কিন্তু এটাকে কি নারী মুক্তি বলা হবে? বেঁচে থাকতে তার ওস্তাদ তাকে কখনো মুক্তি দেয়নি। একবারও বলেনি, রেড লাইট এলাকা থেকে দূরে গিয়ে গানের চর্চা করতে। মায়াও কখনো চেষ্টা করেনি। তাহলে? এখানে কেবল একটি সমান্তরাল ঘটনা এগিয়ে গেছে।



অভিনয়
সিনেমার প্রথমার্ধে বেশ ভালো লেগেছে। সুন্দরভাবে একটি গল্প এগিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এই সিনেমায় সব জাঁদরেল অভিনয়শিল্পীর মেলা বসেছিল। কিন্তু সব অভিনেতা পর্যাপ্ত অভিনয় করার সুযোগ পাননি। পুরো ছবি জুড়ে তিশা, ইয়াশ, ফজলুর রহমান বাবু, আফরোজা বানু, আব্দুল্লাহ রানা ও আবিদ রেহানের উপস্থিতি বেশি ছিল।

এই ছবির মাধ্যমে প্রথমবার বড় পর্দায় একসঙ্গে অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা ও ইয়াশ রোহান। এর আগে তারা ওয়েব প্ল্যাটফর্মে কাজও করেছেন। কিন্তু বড় পর্দায় তিশার বিপরীতে ইয়াশ! এই অসমবয়সী জুটি অনেকের হজম না হবার কথা। বিষয়টা অনেকটা বাংলাদেশ-নেপাল ক্রিকেট ম্যাচের মতো। কিন্তু পৃথকভাবে তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে স্বভাবসুলভ অভিনয় করেছেন। যদিও অজ্ঞাত কারণে তাদের রসায়নটা জমে ওঠেনি। তিশা যখন ইয়াশের গালে চুমু খেয়েছে, তখন মনে হয়েছে খালা তার ভাগ্নেকে স্নেহের চুমু দিয়েছে। ইয়াশের চরিত্রটি রোমিও টাইপ চরিত্র। পুরো ছবিতে তার শুধু লুতুপুতু প্রেম করে সময় কেটেছে। প্রেমিক হিসেবে ইয়াশ ঠিকঠাক ছিল।

 

ওদিকে ফজলুর রহমান বাবু মাতাল গানের শিক্ষকের চরিত্রে মানিয়ে গেছেন বেশ। খল চরিত্রে আব্দুল্লাহ রানা শুরু থেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ছবির শেষ দিকে তিনি কিছু একটা কাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছেন। এই যে আগে থেকে দর্শক বুঝে যাচ্ছে, এটা অভিনেতার ব্যর্থতা। তবে রাইসুল ইসলাম আসাদ, মামুনুর রশীদকে ব্যবহার করতে পারেনি পরিচালক। এই দুই জাঁদরেল অভিনেতার উপস্থিতি ছিল বিরতির পর। তবে বিরতির আগে রাইসুল ইসলাম আসাদ কয়েকবার কিছু সময়ের জন্য দেখা দিয়েছেন।

রাইসুল ইসলাম আসাদকে হাজির করা হয়েছে বয়স্ক উকিল হিসেবে। তার ধীর গতির কথা বলা। প্রতিপক্ষের উকিলকে কাউন্টার করতে না পারা সত্যিই হতাশার। যদিও এ সবকিছুর অধিকাংশ দায়ভার বর্তায় চিত্রনাট্যের ওপর। গ্রামের মামা চরিত্রে অভিনয় করা কাজী রাজুর অভিনয় ভালো লেগেছে। পর্দায় তার স্বল্প উপস্থিতি হলেও অভিনয়, মুখের অভিব্যক্তি ছিল প্রশংনীয়।

পরিচালনা ও চিত্রনাট্য
এই সিনেমা চিত্রনাট্য কোনো আহামরি গল্পের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়নি। যৌনপল্লীর সাধারণ একটি গল্পকে বাড়তি রঙ মিশিয়ে অতিরঞ্জিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যার ফলে পুরো চিত্রনাট্য হয়ে উঠেছে অযাচিত দৃশ্যের সমাহার।

নারীর বলা ‘না’কে যেন সবাই শ্রদ্ধা করে, সেটার আলোকে পুরো চিত্রনাট্য। তবে এই ছবিতে এই ‘না’কে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ছবির একদম শেষ দিকে গিয়ে। শুরুর দিকে ‘না’ শব্দটিকে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো মজবুত দৃশ্য চোখে পড়েনি। যদিও তিশা প্রথমে একবার ইয়াশকে বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, তিনি এসব (শরীর বিক্রি) কাজ করেন না। ইয়াশও তাকে বোঝাতে চেয়েছেন তিনি এসব কাজ করেন না। নারীর ‘না’কে শ্রদ্ধা করেন। তবে এটা যথেষ্ট নয়। প্রতিপাদ্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শুরু থেকে ঘটনার অবতারণ করতে হয়, যেটার শেষ দেখতে গাঁটের টাকা খরচ করে টিকিট কেটে আসা দর্শক শেষ দৃশ্য অবধি বসে থাকবেন।

তিশা যখন প্রথম গান গাইতে ট্রাকে চড়ে বসেন তখন পথে যেতে যেতে তার ছোটবেলার ট্র্যাজেডির কথা মনে পড়ে। সেগুলো ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয়। ওই সময়ে ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়া, ফ্ল্যাশব্যাক দেখানোর কোনো যথার্থ কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিশা যখন গ্রামে যান। নিজ ভিটায় যান। তখন যদি এসব ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যের অবতারণা হতো তখন মানানসই হতো। কিংবা কোনো একদিন নিজের জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে ইয়াশকে বা তার মা আফরোজা বানুকে নিজের মর্মান্তিক অতীতের কথা বলতেন তাহলে সেটা বেমানান হতো না।

 

তাছাড়া কোনো কোনো গেরস্ত বাড়ির ছেলে অবাধে যৌন পল্লীতে ঘুরে বেড়ানো, মাকে যৌনপল্লীর মেয়েকে ভালোবাসার কথা বললে সহজে মেনে নেয়া- এসব বাস্তবের সাথে বড্ড বেমানান। পরিচালক বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন কিনা বলতে পারছি না। বিষয়ভিত্তিক সিনেমার ক্ষেত্রে এমন কাহিনী দেখানো চোখে লেগেছে।

আর হ্যাঁ, শুরুতে যৌন পল্লীতে শিশু মায়ার ঠোঁটে, মুখে ফজলুর রহমান বাবুর হাত বোলানো দৃষ্টিকটু লেগেছে। শিশুদের শরীরে এভাবে হাত বোলানো পর্দার এপারে কতিপয় মানুষদের উৎসাহিত করবে। কারণ, আজকাল শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসা বেড়ে চলেছে।
বিরতির পর সিংহভাগ অংশ জুড়ে ছিল আদালত। এই ছবিটি যে বলিউড ‘পিঙ্ক’ ছবির অনুপ্রেরণায় নির্মিত হয়েছে সেই ছবিতে কোর্টের দৃশ্যের কথা একবার ভাবুন। সেখানে কোর্টে যে টান টান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল তার ছিঁটেফোটাও ‘মায়াবতী’ ছবির কোর্টে পাওয়া যায়নি। বাদী পক্ষের উকিল তানভীর হোসেন প্রবাল যেভাবে কোর্টে কথা বলেছেন তাতে মনে হয়েছে তিনি বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দিচ্ছেন। নতুবা কবিতা আবৃতি করছেন। আর রাইসুল ইসলাম আসাদ তো কথাই বলতে পারেন না। একটা কোর্টের দৃশ্য জমিয়ে রাখতে যেরকম যুক্তি, তর্ক উপস্থাপন করা উচিত তার পুরোটাই ছিল অনুপস্থিত।

বাদী পক্ষের উকিল তানভীর হোসেন প্রবাল তিশার ‘নূন্যতম’ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চান। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড ‘সর্বোচ্চ’ শাস্তি, নূন্যতম নয়। আর মামলা রায় হয়ে যাওয়ার পর জজ কিভাবে মামলা ‘বাতিল’ করে দেন সেটা বোধগম্য নয়। যেখানে রায় হয়ে যায়, সেখানে মামলা বাতিল হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।



আবার এই ছবিতে মায়ার পক্ষে যখন সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলো তখন ঢাকার কিছু আন্দোলনের স্থিরচিত্র ব্যবহার করা হয়। অথচ আলাদা করে দৃশ্য ধারণ করলে আরও বাস্তবিক হতে পারত। টিভিতে যখন নীরব উপস্থাপন করছেন তখন তিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন ‘আর জে নীরব’ বলে।

এক কথায় বলা যায়, পরিচালক ছবিটি নির্মাণের ক্ষেত্রে গুবলেট পাকিয়ে ফেলছেন। একজন সিনিয়র চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে অরুণ চৌধুরীর এই বিষয়গুলো খেয়াল করার উচিত ছিল।

সঙ্গীত ও আবহ, ক্যামেরা ও সম্পাদনা
সিনেমাটির আবহ সঙ্গীত হতাশ করেছে। দৃশ্য উপযোগী আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার হয়নি। সম্পাদনাও যাচ্ছেতাই। চিরকুটের গাওয়া গানটি অর্থবহ ছিল। সুরও বুকে লেগেছে। কিন্তু তিশার লিপ সিং মেলেনি । অন্যান্য গানেও তিশার লিপ সিং মেকি মনে হয়েছে। যার ফলে, গানের দৃশ্য বিরক্ত বাড়িয়েছে। ক্যামেরার কাজ ছিল ড্রোন কেন্দ্রিক । অপ্রয়োজনে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। সাসপেন্স দৃশ্যের সময় যেভাবে ক্যামেরা ওয়ার্ক ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কম্বিনেশন দরকার, তা ছিল না। সবমিলিয়ে তথৈবচ একটি অবস্থা।

 

 

শেষের কথা
মুক্তির আগে ‘মায়াবতী’ ছবির প্রচারণা উদাহরণ হয়ে থাকবে। শুধ সিনেমা নির্মাণ নয়, প্রচারণাও ফ্যাক্ট; বিষয়টি অনুধাবন করতে শেখাবে। একথা স্বীকার করতেই হবে, ‘মায়াবতী’ একটি ভিন্ন ধারার সিনেমা। ভালো নির্মাণের চেষ্টা করেছেন পরিচালক। তবে এধরনের সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে চোখ কান খোলা রাখতে হয়। দায়সারা কাজ গ্রহণযোগ্য নয়। একটু সচেতন হলে ছবিটি বাংলাদেশের মাইলফলক হতে পারত। আশাকরি গুণী নির্মাতা অরুণ চৌধুরী তার আগামী সিনেমাগুলোতে এসব ভুল ত্রুটি শুধরে নিবেন। চলচ্চিত্রের দুর্দিনে তার মতো পরিচালকের প্রয়োজন।


লেখক: রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ, সাংবাদিক, সারাবাংলা ডট নেট

এ সম্পর্কিত আরও খবর