কিংবদন্তি ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর একমাস আগেই শিল্পীকে স্মরণ করতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে রূপালি গিটার স্মারকের উন্মোচন করা হয়। এর মাধ্যমে বরেণ্য শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর ফেলে যাওয়া সেই রূপালি গিটার আবারও ফিরে এসেছে তার জন্মভিটা চট্টগ্রামে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর আইয়ুব বাচ্চুর রূপালি গিটারের আদলে স্থাপিত গিটারটি উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। গুণী এই শিল্পী মারা যাওয়ার পর চসিক মেয়র ঘোষণা দিয়েছিলেন, আইয়ুব বাচ্চু স্মরণে চট্টগ্রামে কিছু করবার। ঘোষণার প্রায় এক বছরের মাথায় চট্টগ্রামে স্থাপিত হয় ‘রূপালি গিটার’।
চট্টগ্রামের গোল পাহাড় মোড় থেকে প্রবর্তকের দিকে যাওয়ার সময় গিটারটির সামনের অংশ চোখে পড়ে। সাড়ে চার ফুট বেদির ওপর ১৮ ফুট উঁচু স্টিলের গিটারটি সূর্যের এবং চাঁদের আলোয় তৈরি প্রতিবিম্ব লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া রাতে চারপাশ থেকে বর্ণিল আলোর ফোয়ারাও নজর কাড়ে।
এটি চোখে পড়তেই গুন গুন করে অনেকে গেয়ে ফেলেন শিল্পীর ‘এই রূপালি গিটার ফেলে’ গানটি। আবার কেউ আসেন তার রুপালি গিটার ছুঁয়ে দেখতে, কেউবা এসে সেলফি তুলে নিচ্ছেন।
এমনই একজন এলআরবি ব্যান্ডের ভক্ত উইলস ব্যান্ডের প্রাক্তন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ফখরুল ইসলাম। ব্যস্ত এই রাস্তা ধরে প্রায়ই তার যাতায়াত। না ফেরার দেশে চলে যাওয়া আইয়ুব বাচ্চুর ভক্ত হওয়ার পাশাপাশি তার সঙ্গে চট্টগ্রামে শো করার সৌভাগ্যও হয়েছে তার। রুপালি গিটার প্রসঙ্গে ফখরুল ইসলাম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম বলেন, ‘আইয়ুব বাচ্চু আমাদের প্রজন্মের কাছে একজন শিল্পীর পাশাপাশি একটি ব্র্যান্ড। তার গান শুনে বড় হওয়া, বেড়ে ওঠা। শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার সময় দেখেছি মানুষটি কতটা প্রাণবন্ত এবং ডাউন টু আর্থ। আমি একজন জুনিয়র আর্টিস্ট তার সঙ্গে কাজ করছি, এটি তিনি অনুভব করতে দেননি। নিজের দলের মানুষের মতোই আমার সঙ্গে মিশেছেন শো-গুলো করার সময়। এই মানুষটির স্মরণে নির্মিত রুপালি গিটার আমাকে স্মৃতিকাতর করে। চট্টগ্রামে তাকে নিয়ে এমন একটি স্থাপত্য তৈরি হয়েছে, ব্যাপারটি নিয়ে আমি সত্যিই গর্বিত।’
নগরীর প্রবর্তক মোড়ে সৌন্দর্যবর্ধন ও গিটার স্থাপন করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। রূপালি গিটারের পাশাপাশি নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে প্রবর্তক মোড় ও আশপাশের এলাকার উন্নয়ন কাজটি করেছে বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান ‘আদিওস ইঙ্ক’ এবং ‘স্ক্রিপ্ট’। স্থাপনাটির স্থপতি চসিকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এ কে এম রেজাউল করিম। ডিজাইন ভিজ্যুয়ালাইজেশন করেছেন স্ক্রিপ্টের হেড অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ সোহান মাসুদ।
১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম। চট্টগ্রামের অলিতে গলিতে গিটার হাতে নিয়ে তার বেড়ে উঠা। কৈশোরে গানে গানে মাতিয়ে রাখতেন এই শহরের মানুষদের। চট্টগ্রামে ১৯৭৬ সালে কলেজ জীবনে ‘আগলি বয়েজ’ নামক ব্যান্ড গঠনের মাধ্যমে তার সঙ্গীত জীবনের সূচনা করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ‘ফিলিংস’য়ে (বর্তমানে ‘নগর বাউল’ নামে পরিচিত) যোগদান করেন এবং ব্যান্ডটির সাথে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। একই বছরে তিনি জনপ্রিয় রক ব্যান্ড ‘সোলসের’ প্রধান গিটারবাদক হিসেবে যোগদান করেন। সোলসের সঙ্গে তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কাজ করেন।
১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু তার নিজের ব্যান্ড ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ গঠন করেন, যা পরবর্তীকালে ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’ বা এলআরবি নামে জনপ্রিয়তা পায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ২৭ বছর তিনি ব্যান্ডটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
আইয়ুব বাচ্চুর একাধিক গানে ভিন্ন ধারার মাদকতার পাশাপাশি একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা প্রকাশ পেয়েছে। কারণ ব্যক্তিজীবনে এই শিল্পী অনেকটাই নিঃসঙ্গ ছিলেন। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে তার দূরত্ব শিল্পীর নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করার একটি কারণ। শুরুর জীবনে বাবা ইশহাক চৌধুরীর সঙ্গে তার দূরত্ব থাকলেও গানের শুরুটা কিন্তু বাবার মাধ্যমেই। আইয়ুব বাচ্চুর ১১তম জন্মদিনে বাবা ইশহাক চৌধুরী তাকে একটি গিটার উপহার দেন। সেখান থেকেই গানের ভুবনে যাত্রা শুরু করেন এই তারকা।
গত বছর ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকাল আইয়ুব বাচ্চু। ২০ অক্টোবর নগরীর স্টেশন রোডের বাইশ মহল্লা চৈতন্য গলি কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয় এ কিংবদন্তি শিল্পীকে।