বাকী হিজড়ার বদলে যাবার গল্প

, ফিচার

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 12:02:26

রংপুর: আবদুর রহমান বাকী। বাকীর শৈশব অন্য ছেলে শিশুদের মতো না। পুতুল খেলা নিয়েই কাটে তার শিশুকাল। খেলার সঙ্গীও ছিল মেয়ে শিশুরা। বয়স যখন বারো, ব্যস্ত হয়ে উঠেন যাত্রাপালার নাচ-গান নিয়ে। পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে যাত্রাদলে মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করতেন।

রঙে ঢঙে মঞ্চ মাতিয়ে আনন্দ দিতেন দর্শকদের। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসে বাকীর আচার-আচরণে। পরিবর্তন হয় শারীরিক গঠনেরও। শুরু হয় মেয়েলি স্বভাবের আচরণ আর সাঁজগোজ। হতাশ হয় পরিবার। মানুষের ঠাট্টা আর উপহাসে ঘর ছাড়ে বাকী। পরিবারের আদর সোহাগ বঞ্চিত বাকী সমাজের কাছে পরিচিত পায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে।

হিজড়া শব্দের বেড়াজালে থাকা অবহেলিত বাকী অন্য হিজড়াদের মতো নয়। সে মানুষকে অতিষ্ট করতে পছন্দ করত না। কাউকে জিম্মি টাকা নেয়াটাকে খারাপ মনে হত বাকীর চোখে। তাই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে কাজ খুঁজতে থাকেন। এক সময় নিজ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমায়। কাজ খুঁজে নেয় পীরগঞ্জ সদর উপজেলা সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে। সেখানে কিছুদিন ঝাড়ুদারের কাজ করেন। পরে তার ব্যবহারে মুগ্ধ সরকারি কর্মকর্তারা তাকে দিয়ে রান্না করান। এভাবেই সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে জীবনের ১৮টি বছর কেটে যায়। ওই সময়ে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হয়ে ওঠে সে।

এখন বাকী নিজেই পীরগঞ্জ কলেজ রোডে হোটেল ব্যবসা শুরু করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘আদর-সোহাগ হোটেল’। সেখানে চার জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতিদিন তাদেরকে ১২শ টাকা করে হাজিরা দেয়া হয়। ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে সেই হোটেলটি চলছে। হিজড়াদের ব্যাপারে অন্যদের দৃষ্টি ভঙ্গি বদলাতেই নিজেকে কাজের সাথে জড়িয়ে এভাবেই বদলে নিয়েছেন।

তৃতীয় লিঙ্গের আবদুর রহমান বাকী রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। সে পীরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের গঙ্গারাম গ্রামের মৃত আবদুল জলিলের ছেলে। পিতাহারা পরিবারের দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বাকী সবার বড়। অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী বাকী এখন মডেল। কর্ম দিয়ে মানুষের মন জয় করা বাকী ইতো মধ্যে গ্রামে কৃষি জমি কিনেছেন। নিজের উপার্জিত অর্থে বিয়ে দিয়েছেন ছোট ভাই-বোনদেন।

পীরগঞ্জের কলেজ রোডে কবি হেয়াত মামুদ কিন্ডার গার্টেন এর সম্মুখে ‘আদর-সোহাগ হোটেল’ এ বার্তা২৪.কম এর সঙ্গে কথা হয় বাকীর। ৪৮ বছর বয়সী বাকী জানান, সে সরকারী অফিসার্স কোর্য়াটারে ১৮ বছর বাবুর্চির কাজ করেছেন।

কোর্য়াটারের অফিসারদের কাপড় ওয়াস করে দিতেন। অনেক কষ্টে সেখানে থাকতেন। অফিসারদের খুশি করতে পারলে মাঝে মধ্যে ১’শ থেকে ২’শ টাকা বকশিস পেতেন। বকশিসের জমানো সেই টাকা দিয়ে নিজের পছন্দের শাড়ি, ব্লাউজ, জামা ও প্রসাধনী কিনে নিতেন। সময় পেলে প্রায়ই ছুটে যেতেন মঞ্চে।  এসময় অনেক হিজড়ারা তার কাছে আসত।

বার্তা২৪.কমকে বাকী বলেন, আমি পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়নি। জীবনের সাথে সংগ্রাম করেছি। সামান্য বেতনে সরকারী স্টাফ কোয়ার্টারে কর্ম করে নিজেকে বদলে নিয়েছি। সেই বেতন থেকেই সে পরিবার পরিজনকে সাহায্য করেছি। গ্রামে জমি কিনেছি। শুধু নিজের ওপর জেদ করেই আজকে এ পর্যায়ে এসেছি।

এদিকে বাকীর হোটেল খাবার খেতে আসা পল্লী বিদুৎ সমিতির পীরগঞ্জ জোনাল অফিস কর্মচারী ইয়াজুল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রতিদিন এক বেলা হলেও এখানে আমি খাবার খেতে আসি। হোটেলের পরিবেশ  ও রান্না মানসম্মত। এখানে পীরগঞ্জের বেশির ভাগ সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা দুপুরের খাবার খেতে আসেন বলেও জানান তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর