লেবাননের ভাগ্যাকাশে কালোমেঘ

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 02:59:01

বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইসরায়েল মৈত্রীর সূচনা হওয়ায় সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতির শিকার হয়েছে ফিলিস্তিন ও লেবানন ইস্যু। ইহুদি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের অধিকার আদায়ের বিষয়টি এতে শক্তিহীন হয়েছে এবং সংঘাতে জর্জরিত লেবাননের ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে। বিশেষত লেবাননের ভাগ্যাকাশে দেখা দিয়েছে কালোমেঘ।

সাম্প্রতিক সময়ে আরব-বিশ্বের একটি অংশের সঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের মৈত্রীর ফলে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত লেবাননের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছে কালো ছায়া। ইসরায়েল পাশের দেশ লেবাননের ভূমি বার বার দখল করেছে। ইসরায়েল থেকে লক্ষ লক্ষ আরব মুসলিমকে ঠেলে দিয়েছে লেবাননে। আর একমাত্র লেবানন থেকেই ইরান সমর্থিত যে শিয়া মিলিশিয়ারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তারাও কোণঠাসা হয়ে গেছে। ফলে লেবাননকে শায়েস্তা করতে ইসরায়েল এবার ভিন্ন পথে এগুবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। নানা মত ও পথে বিভক্ত লেবাননকে ভাগাভাগি করার ফর্মুলা দিচ্ছে ইসরায়েলপন্থী বিশেষজ্ঞরা।  

প্রতিবাদী কবি কাহলিল জিবরানের মাধ্যমে পরিচিত হলেও লেবানন হলো এমন এক প্রাচীন জনপদ, যার কথা ৭১ বার ওল্ড সেস্টামেন্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে যে খণ্ডিত দেশটি লেবানন নামে পরিচিত, তার জন্ম ১৯২০ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির তত্ত্বাবধানে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা শক্তিগুলো বিজয়ীর আসনে এসে বিশ্বের বহু দেশ ও জনপদকে খণ্ড-বিখণ্ড ও ভাগভাগি করে নেয়। এশিয়া, আফ্রিকার বহু দেশ এভাবে ইউরোপের নানা বৃহৎ শক্তির দখলে আসে। 

কিন্তু গত ১০০ বছরে লেবানন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার মুখ দেখলেও শান্তি ও স্থিতিশীলতার দেখা পায় নি। পুরো দেশ তো বটেই, রাজধানী বৈরুতও পরিণত হয়েছে সংঘাতময়, রক্তাক্ত ও জ্বলন্ত শহরে। ইসরায়েলি হামলা ও দখলদারিত্ব এবং নিজেদের মধ্যে লড়াই ও আন্তঃকলহ দেশটিকে বিশ্বের সবচেয়ে নাজুক, ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল ও বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করেছে।

লেবাননের অনেকটা ভূমিই ইসরায়েলের জবরদখলে। বাকিটা খ্রিস্টান, দ্রুজ, সুন্নি ও শিয়া মুসলিম গ্রুপগুলোর মধ্যে বিভক্ত। সবাইকে নিয়ে ফেডারেল ধরনের সরকার চালানোর বহু চেষ্টা করা হয়েছে লেবাননে। খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভাগাভাগিও করা হয়েছে। কখনো প্রেসিডেন্ট খ্রিস্টান হলে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে মুসলিম কাউকে। তথাপি শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি দেশটিতে। নিজেদের বিভেদের কারণে ইহুদি আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধের একাট্টা হয়ে রাজনৈতিক বা সামরিক লড়াই করাও সম্ভব হয়নি লেবাননের পক্ষে। সম্ভব হয়নি অর্থনীতিকে বাঁচানো। ফলে লেবানন পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্ত, গৃহহীন, দরিদ্র ও আক্রান্ত মানুষের দেশে।

আর এই সুযোগটিই নিতে চাচ্ছে ইসরায়েল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরবের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশকে পাশে পাওয়ায় ইসরায়েলের বিশেষজ্ঞরা লেবাননকে ভাগ করার ফর্মুলা দিচ্ছেন। এতে কয়েকভাগে বিভক্ত লেবানন আরো শক্তিহীন হবে এবং ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আর কিছুই করতে পারবে না।

২০২০ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা জার্নাল ‘ফরেন পলিসি’তে জোসেফ কেচিয়ান এক প্রবন্ধে লেবাননের সমস্যা সমাধনের জন্য ‘পার্টিশান ইজ ওনলি সলিউশান’ বলে যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। লেবাননের দীর্ঘ ইতিহাস পযালোচনা করে এই গবেষক, যিনি প্রত্যক্ষভাবেই পশ্চিমা জোট ও ইসরায়েলের প্রতি সহানুভীতিশীল, ভাগাভাগির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, বিভিন্ন ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠীর পক্ষে লেবাননে একসঙ্গে থাকা অসম্ভব। ফলে সঙ্কট উত্তরণ ও শান্তির জন্য লেবাননকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে দেওয়াই ভালো, যাতে বিভিন্ন গ্রুপ ও গোষ্ঠী নিজেদেরকে শাসন ও পরিচালনা করতে পারে।

পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের পক্ষে থেকে উত্থাপিত ভাগাভাগির এই ফর্মুলা মোটেও নতুন নয়। অতীতে বার বার ভাগ-বোটোয়ারা করে নানা দেশ ও জাতিকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে। এতে শান্তি তো আসেই নি, বরং সংঘাত ও সঙ্কট আরো বেড়েছে। ভারত উপমহাদেশ ভাগ করার ঘটনাটি একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। গত ৭৩ বছরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তির চেয়ে সংঘাতের অভিজ্ঞতাই বেশি।পূর্ব ইউরোপের বলকান রাষ্ট্রগুলোর কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোকে ভাগ করার পরিণাম এখনো বিভিন্ন ধরনের আন্তঃসম্প্রদায়, জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক সশস্ত্র-রক্তাক্ত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেখতে পাওয়া যায়।

ঐতিহাসিকভাবেই ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল স্থানীয় আরবদের জায়গা দখল করে মধ্যপ্রাচ্যে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে বিভেদ ও সংঘাতের বীজ রূপে কাজ করছে, যা এখনো চলমান। মার্কিন ছত্রছায়ায় এবং মার্কিনপন্থী আরব রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে যে মৈত্রী ও শান্তির কথা বলা হচ্ছে, তার প্রকৃত স্বরূপ এখনো অজানা। ইসরায়েল যদি আরবের নব্য-বন্ধুদের কাঁধে বন্দুক রেখে লেবানন ও অন্যান্যদের শায়েস্তা করতে বা বিভক্ত করতে কাজ করে এবং মার্কিনিরা অস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর কাজটি করে, তাহলে শান্তি নয়, মধ্যপ্রাচ্য আরো অশান্ত ও রক্তাক্তই হবে।

মিশর, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর বাইরাইণও ইসরায়েলের মিত্রে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব নেপথ্যে এ মৈত্রীর পৃষ্ঠপোষক। প্রথমবারের মতো কোনো ইসরায়েলি শীর্ষ নেতার সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয় সফরের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক বৈরিতা থেকে মৈত্রীর পথে চলেছে। এতে লেবানন, ফিলিস্তিন ইস্যুসহ ইসরায়েলের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে জোরালো দেন-দরবারের পথ সীমিত হচ্ছে এবং ইসরায়েলের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও জাতিগুলোর অধিকার আদায়ের জায়গাটুকুও ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে, যার প্রভাব দুর্ভাগ্যগ্রস্ত লেবাননে আরো চরমভাবে দেখতে পাওয়ার আশঙ্কাই করছেন বিশ্লেষকরা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর