পুরো ২০২০ সাল সংক্রমণের পর বছর শেষে ভ্যাকসিন এলেও বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের বিরূপ পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যাবে বলে মনে করার কারণ নেই। কেননা, এরই মাঝে করোনার নতুন ধরণের বিস্তার হচ্ছে ইউরোপে, যার সংক্রমণের হার সত্তর ভাগ বেশি। ফলে করোনা মহামারির বিপদের মধ্যেই আসছে আরেকটি নতুন বছর ২০২১ সাল। আবর্তিত হচ্ছে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ।
নতুন সংক্রমণের মুখে যুক্তরাজ্যে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চলছে কঠোর লকডাডন। বন্ধ রয়েছে বিমান চলাচল। বিশ্বের বহুদেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। গ্রহণ করেছে বহুবিধ সতর্কতামূলক বিধি-ব্যবস্থা।
করোনার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের ব্যবহার ও নতুন সংক্রমণের পটভূমিতে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কটের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে। পুরো একটি বছরের বৈশ্বিক মহামারি মানুষের জান ও মালের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। বাড়িয়েছে মন্দা ও বেকারত্ব।
অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) তার সর্বশেষ 'গ্লোবাল ইকোনোমিক আউটলুক' রিপোর্টে জানিয়েছে, 'ভ্যাকসিন এলেও অর্থনীতির গতি মন্থর থাকবে'। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে যে ধস নেমেছে, তা খুব সহজে ও অতিদ্রুত কাটবে না বলেও মন্তব্য করেছে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে কর্মরত এ সংস্থা।
'ওইসিডি'র বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, 'তবে অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে উদ্ধারের কাজটি নানা কারণে শ্লথ হলেও ব্যতিক্রম হবে চীন। চীন করোনা মোকাবেলা করেও নিজের অর্থনীতির গতি বাড়িয়ে রাখতে সক্ষম হবে।'
সংস্থার মতে, সামনের বছরে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ৪.২ শতাংশ, যার সিংহভাগই চীনের দখলে থাকবে। চীন নিজের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও সুইডেনের করোনা বিপর্যস্ত অর্থনীতির গতিও ক্রমশ ঊর্ধমুখী হবে। তবে ইউরোপের অনেকগুলো দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশকে করোনার কারণে আর্থিকভাবে ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হবে।
করোনাজনিত কারণে অসাম্য বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করেছে অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)। বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে তুলনামূলক বেশি। এসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হয়ে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। ভ্যাকসিন এলেও এসব খাত মাথা তুলে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে।
ওইসিডি তাদের সুপারিশে বিশ্বের দেশগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষা ক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কারণ, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সর্বস্তরে ভ্যাকসিন আসতে আসতে এক বছরও লেগে যেতে পারে। ততদিন আর্থিক, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে করতে হবে প্রায়-সকল দেশকেই। আর ভ্যাকসিন এলেই সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে।
উল্লেখ্য, করোনার কারণে বিপুল মানবিক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সীমাহীন। ২০১৯ সালে বিশ্বে যে আর্থিক প্রবৃদ্ধি বিরাজ করছিল, তা আরো সঙ্কুচিত হয়েছে। পুরো ২০২০ সালের ধাক্কা সামলিয়ে বিশ্বের জিডিপি ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার নিচে নেমে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব।
'আমি কখনো ভাবিনি খাবারের জন্য হাত পাততে হবে', বলেছেন দুই সন্তানের জননী, যার নাম প্রকাশ করা হয়নি মিডিয়ায়। তিনি শিকাগোর হিলসাইড 'ফুড ব্যাঙ্ক'-এ এসেছেন খাবাবের জন্য।
করোনা মহামারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে খাদ্য সঙ্কটের এমন চিত্র ক্রমেই বাড়ছে। পেন্ডেমিকের ধাক্কায় যে আর্থিক মন্দা শুরু হয়, তাতে শিল্প ও ব্যবসায় ধস নামে। চাকরি হারান হাজার হাজার মানুষ। শুরু হয় বিপন্ন পরিবারগুলোতে খাদ্যাভাব।
এপি'র শ্যারন কোহেল এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছেন, করোনার প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দারিদ্র্য ও খাদ্যাভাব। অনেকে চাকরি হারিয়ে বাসাবাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন এবং খাদ্য সাহায্য কেন্দ্রের সামনে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক মিলিয়ন মার্কিনী এখন 'ফুড ব্যাঙ্ক' বা খাদ্য সাহায্য কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। 'ফিডিং আমেরিকা' নামের দেশের সবচেয়ে বড় এন্টি-হাঙ্গার সংগঠনের তথ্যানুযায়ী গত আট মাসে ৪.২ বিলিয়ন মিল (এক বারের খাবার) বিতরণ করা হয়েছে, যা অভূতপূর্ব। অতীতে কখনোই এতো খাবারের চাহিদা তৈরি হয়নি, যা করোনা মহামারিকালে হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভবঘুরে ও দরিদ্রের মধ্যে খাবার দেওয়া প্রচলন বেশ পুরনো। তবে সেগুলো ছিল সীমিত ও পরিমিত। কিন্তু করোনায় ক্ষুধার্ত মানুষের চাপ অসহনীয় আকারে বাড়ছে।
এপি'র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ফুড ব্যাঙ্কগুলোয় অতীতের চেয়ে ৫৭% ভাগ বেশি খাবার সরবরাহ করতে হচ্ছে এবং খাবার প্রত্যাশী মানুষের চাপ ও খাদ্যের চাহিদা ক্রমবর্ধমান গতিতে বাড়ছে।
বড় বড় শহরগুলোতে খাবার প্রত্যাশীদের ভিড়ে ট্রাফিকজ্যাম তৈরি হচ্ছে। ক্ষুধার্ত পরিবারগুলোর সব সদস্য খাবারের জন্য বাড়ির বাইরে এসে সাহায্য কেন্দ্রগুলোতে জড়ো হচ্ছেন। অনেকেই শীতের কারণে বেশি খাবার সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টা করছেন।
ক্ষুধার্তদের সারিতে আফ্রিকান-আমেরিকান এবং স্পেনিশ-আমেরিকানের সংখ্যাই অধিক। কোথাও কোথাও এশিয়ান-আমেরিকানদেরও লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেছে। লাইনে দেখা যাচ্ছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের।
শীত আরো তীব্র হলে করোনার প্রকোপ যেমন বাড়তে পারে, তেমনি বাড়বে বেকারত্ব ও মন্দা। এতে ক্ষুধার্তদের সংখ্যাও আরো বাড়বে। বাড়বে খাবারের চাহিদাও। ফলে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের তীব্রতার মতোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক মন্দা ও ক্ষুধার্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে করোনা-দগ্ধ ২০২০ সালের বিদায়ে বিপদাপন্ন ২০২১ সালের ত্রস্ত আগমন ধ্বনি।