নিঃস্বার্থ উদারতা-পরোপকার কেন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?

, ফিচার

শুভ্রনীল সাগর, স্পেশালিস্ট রাইটার, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 00:50:28

বেটি লোওয়ে’র বয়স যখন ৯৬, তখন সংবাদমাধ্যমগুলো তাকে নিয়ে লেখা শুরু করে। অবসরে যাওয়ার বয়স পার করেও তিনি যুক্তরাজ্যের স্যালফোর্ড রয়্যাল হসপিটালে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছিলেন। কফি এনে দেওয়া, থালাবাটি ধোওয়া কিংবা রোগীদের সঙ্গে গল্প করা তার রোজকার কাজ।

এরপর বেটি একশো বছরে পা দিলেন। ইংলিশ সংবাদমাধ্যমগুলো শিরোনাম করল, ‘স্টিল ভলানটিয়ারস অ্যাট হসপিটাল’– মানে, এখনও হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক। এরপর বয়স হলো ১০২। বেটি আবার শিরোনামে, ‘স্টিল ভলানটিয়ারিং’। ধীরে ধীরে ১০৪, ১০৬…। চোখে দেখতে সমস্যা হলেও শতবর্ষ পার করা এই মহাত্মা এখনও সপ্তাহে একদিন ক্যাফেতে কাজ করে চলেছেন।

যে বয়সে তার অন্যের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করার কথা, সেই বয়সে তিনি বরং অন্যকে সাহায্য করে চলেছেন। এ নিয়ে তার ভাষ্য, স্বেচ্ছাসেবীমূলক কাজকর্মই তাকে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতে সাহায্য করেছে।

বেটির কথার সঙ্গে একমত বিজ্ঞানও। গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ও পরোপকারী আচরণ মানুষকে সুস্থ রাখে এবং দীর্ঘ আয়ু দেয়।

স্বেচ্ছাসেবী কাজকর্ম অকাল মৃত্যুর হার ২৪ শতাংশ কমিয়ে দেয় – যা রোজ ছয়টির বেশি ফল ও সবজি খাওয়ার সমান। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবকদের হাই ব্লাড গ্লুকোজ ঝুঁকি কমে যায় ফলে হৃদরোগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে। স্বেচ্ছাসেবীমূলক কাজে যুক্তদের অন্যদের চেয়ে ৩৮ শতাংশ কম হাসপাতালে যেতে হয়। স্পেন থেকে মিশর এবং উগান্ডা থেকে জ্যামাইকা – ‘গলআপ ওয়ার্ল্ড পোল’ জরিপ চালিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে।

ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি’র মনোবিদ ও মানবপ্রেম গবেষক সারা কোনার্থ বলছেন, গবেষণা পরিষ্কারভাবেই বলছে, যারা স্বেচ্ছাসেবীমূলক কার্যকমে নিজেদের জড়িত রাখে তারা অপেক্ষাকৃত ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। এটি কেবল মানসিকভাবেই কাজ করে না, জৈবিক ব্যবস্থাকেও তা প্রভাবিত করে বলে ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে।

অন্য একটি সমীক্ষায়, কানাডার উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের একটি দলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এক দল যারা শিশুদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে পড়াতে চায়। যারা পড়াতে চায় না তারা অন্য দলে। চার মাস পর দুই দলের শিক্ষার্থীদের রক্ত পরীক্ষা করে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা গেলো। যারা বাচ্চাদের দুইমাস ধরে পড়ালো, তাদের কোলস্টেরল লেভেল নিচে নেমে যায়। কোলস্টেরল ভাইরাল ইনফেকশন ও হৃদরোগের জন্য ভীষণভাবে দায়ী।

বৈশ্বিক মহামারীর কারণে ঘরের বাইরে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজকর্ম করাটা একটু কঠিন। তবে অনলাইনে স্বেচ্ছাসেবা দিলেও তা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো বলে মত মনোবিদ সারার।

ক্যালিফোর্নিয়ার একটি গবেষণা বলছে, কেবল আনুষ্ঠানিক স্বেচ্ছাসেবী কাজকর্মই নয়, যেকোনো ছোড়-বড় উদারতাই স্বাস্থ্য ও মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। হতে পারে, কাউকে রাস্তা পার বা গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করা, দুস্থদের সাহায্য বা যেকোনো পরোপকারী আচরণ। সেটি নিছক একটি সুন্দর হাসিও হতে পারে বা দুটো কথা। কাউকে রাস্তা দেখিয়ে দেওয়াটাও লুকোসাইট জিনের কার্যক্রম কমিয়ে দেয়, যা প্রদাহজনিত শারীরিক সমস্যা কমায়। দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, ক্যানসার, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ।

যদি কাউকে পরোপকারী কোনো কাজ করতে বলে ফ্যাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (এফএমআরআই) করা হয় তাহলে দেখা যাবে, মস্তিষ্ক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়। একটি পরীক্ষায়, কয়েকজন স্বেচ্ছসেবীর হাতে হালকা বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরোপকারী কোনো ভাবনা ভাবতে বলা হয়। যারা কাউকে রক্ত দেওয়া বা সুবিধাবঞ্চিতদের অর্থ সাহায্য করার মতো উপকারের কথা ভেবেছে, তারা শকে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি। অন্যদিকে, যারা তুলানামূলক কম উপকারের কথা ভেবেছে, তারা ব্যথা পেয়ে হাত সরিয়ে নিয়েছে। এখানে ব্যথা পেয়ে মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যণীয়।

অন্য একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা ইউনিসেফ’র জন্য অনুদানের চেক লিখেছে তারা অন্যদের চেয়ে গড় ২০ সেকেন্ড বেশি সময় হ্যান্ড এক্সসারসাইজার চাপতে পেরেছে। সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কিছু করতে পারার যে ইতিবাচক মনোভাব ও শক্তি, সেটি স্নায়ুর মাধ্যমে পেশীশক্তিকে প্রভাবিত করেছে বলেই তারা অন্যদের চেয়ে বেশিক্ষণ ব্যায়াম করতে পেরেছে।

এরকম অসংখ্য পরীক্ষা, সমীক্ষা ও গবেষণায় প্রমাণিত, স্বেচ্ছাসেবী ও পরোপকারী মনোভাব ৩৭ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমায় এবং সুস্থভাবে দীর্ঘ আয়ুর দিকে নিয়ে যায়।

সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটি’র নিউরোসায়েন্টিস্ট ফর ত্রিস্তে ইনাগাকি বলছেন, উদারতা ও পরোপকারী আচরণ যে কেবল মানসিক নয়, শারীরিক সুস্থতায়ও প্রভাব ফেলে এ নিয়ে আশ্চর‌্য হওয়ার কিছু নেই।

‘মানুষ ভীষণভাবে সামাজিক। আমাদের অপেক্ষাকৃত ভালো স্বাস্থ্য তখনই হবে যখন আমরা আন্তঃসম্পর্কে যুক্ত ও সুসংবদ্ধ থাকবো। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্য কিছু করা…’

এ সম্পর্কিত আরও খবর